রাস্তায় পুলিশের সহিত জনতার খণ্ডযুদ্ধ চলিতেছে, পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়িতেছে, জনতা বিবিধ সরকারি ভবনে অগ্নিসংযোগ করিতেছে, সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর করিতেছে গ্রিসের রাস্তায় ইদানীং এই ছবিটি প্রায় প্রাত্যহিক ঘটনা হইয়া উঠিয়াছে। সেই দেশে সম্প্রতি দুই দিনব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট পালিত হইল। রাস্তায় বিক্ষোভ এমনই মাত্রায় পৌঁছাইয়াছে, যাহা নাকি গ্রিসের মানদণ্ডেও অ-পূর্ব। নাগরিক ক্ষোভের কারণ, সরকার দফায় দফায় কঠোর আর্থিক নীতি গ্রহণ করিতেছে। সাম্প্রতিকতম কঠোর নীতিটি সংক্ষেপে এই রকম ১৫,০০০ সরকারি কর্মীর চাকুরি যাইবে; ন্যূনতম মজুরির হার ২০ শতাংশ হ্রাস করা হইবে; শ্রম আইন সংস্কার করা হইবে। সত্যই কঠোর নীতি, নিঃসন্দেহে। গ্রিসের সরকার বলিবে, তাহার হাত পা বাঁধা ইউরো অঞ্চল এবং আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের ঋ
ণ গ্রহণ করিতে হইলে তাহাদের শর্তও মানিতে হয়। ফলে, দেশবাসীকে কষ্ট স্বীকার করিতে হইবে বইকি। আন্তর্জাতিক ঋণ ভিন্ন গ্রিসের গত্যন্তর নাই কেন, তাহা বহুচর্চিত। শুধু এই কথা বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে গ্রিস স্বখাতসলিলে নিমজ্জিত দীর্ঘ দিন যাবৎ নিজের আর্থিক সামর্থ্য অপেক্ষা বহু বেশি ব্যয় করিবার প্রবণতার মাসুল দিতেছে। ইউরো অঞ্চলের সদস্য হওয়ার ফলে ঋণ সহজলভ্য হইয়াছিল। গ্রিসের সরকার সেই সুযোগের পূর্ণ ব্যবহার করিয়াছিল। সন্দেহ নাই, সেই পর্বে গ্রিসবাসীও আনন্দে ছিলেন। কিন্তু, যে ব্যয় আয়ের সহিত সঙ্গতিহীন, তাহা বা তাহার মাধ্যমে প্রাপ্ত আনন্দ চিরস্থায়ী হইতে পারে না। কাল অথবা পরশু বুদ্বুুদ্ ফাটিয়া যায়, তখন বাস্তবের কঠোর জমিতে নামিয়া আসিতে হয়। বাস্তবের সহিত সেই সাক্ষাৎকার প্রীতিপ্রদ হওয়ার কথা নহে। গ্রিসেও হয় নাই। রাজধানী আথেন্সের রাজপথে যে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটিতেছে, তাহা এই বাস্তবের সহিত দুঃখজনক, কিন্তু অনিবার্য সাক্ষাতের প্রতিক্রিয়া।
গ্রিসের ঘটনাক্রম একটি বহুপ্রাচীন শিক্ষার কথা ফের স্মরণ করাইয়া দেয় বিনিপয়সার ভোজ বলিয়া কিছু হয় না। জমা-খরচের ভারসাম্যহীনতা হিসাবের খাতা বেশি দিন সহ্য করে না। গ্রিসের মানুষ আজ যে পরিস্থিতির মধ্যে আছেন, অদূর ভবিষ্যতেও থাকিবেন, তাহা ভয়াবহ। কিন্তু, এই পরিস্থিতি কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয় নহে এই বিপদ তাঁহারা ডাকিয়া আনিয়াছেন। ধারের খাতায় বাঁচিবার অভ্যাসটি গ্রিসের একচেটিয়া, বলিলে মিথ্যাভাষণ হইবে। রাজকোষে খড়কুটাও অবশিষ্ট নাই, এ দিকে সরকার দানছত্র খুলিয়া দেদার বেতন বাড়াইতেছে, এমন উদাহরণ ঘরের কাছে অথবা দূরে, সর্বত্রই বর্তমান। এই অবিমৃশ্যকারিতার ফল কী, গ্রিস তাহার মোক্ষম উদাহরণ। গ্রিসে যে কঠোর আর্থিক নীতি গ্রহণ করিতে সরকার বাধ্য হইতেছে, তাহাই কি সমাধানের পথ? এই প্রশ্নটির স্পষ্ট উত্তর এখনও নাই। কঠোর আর্থিক নীতির মূল প্রবক্তা এখন জার্মানি। যেহেতু ইউরো অঞ্চলে আর্থিক শক্তিতে জার্মানি প্রতিদ্বন্দ্বীহীন, ফলে সেই দেশের মতামতের গুরুত্বও স্বভাবতই বেশি। তবে, কঠোর আর্থিক নীতি ভবিষ্যতের বৃদ্ধির হারের ওপর কী প্রভাব ফেলিবে, গ্রিসের সংকটকে তাহা আরও প্রলম্বিত করিবে কি না, এই সবই খোলা প্রশ্ন। যাহা সংশয়াতীত, তাহা হইল, গ্রিস বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, তাহা সুস্থায়ী নহে। এই পরিমাণ ঋণের বোঝা লইয়া কোনও দেশের অর্থনীতিই সুস্থায়ী হইতে পারে না। দেশের প্রাণরক্ষার স্বার্থেই গ্রিসকে ঋণ-রূপ মেদ বর্জন করিতে হইবে। কাজটি কষ্টসাপেক্ষ, কিন্তু অপরিহার্য। যে দেশগুলি গ্রিসের ন্যায় দেদার ঋণের পথে হাঁটিতেছে, তাহারা একটি শিক্ষা গ্রহণ করিতে পারে মেদ বর্জনের কাজটি যত দ্রুত আরম্ভ করা যায়, যন্ত্রণা ততই কম থাকে। নচেৎ, আরোগ্যে পৌঁছানোর জন্য মানুষের কষ্ট এবং সেই কষ্টসঞ্জাত ক্ষোভের আগুন পার হইতে হইবে। কোনও জনদরদি সরকার কি সত্যই তাহা চাহিতে পারে? |