কথা রাখেননি মায়া, সংশয় অভিমানী ব্রাহ্মণদের নিয়ে
ব্রাহ্মণ্যবাদের অহঙ্কার, না কি বহুজন-সবর্ণ বিবাহে মধুচন্দ্রিমা থেকেই তিক্ত অভিজ্ঞতা! বঞ্চনা ও একাকীত্বের অভিমানে পাঁচ বছর না কাটতেই বিচ্ছেদ আসন্ন! এ বিবাহে যে কোনও দুরন্ত প্রেমের গল্প ছিল না উত্তরপ্রদেশ জানে। পূর্বরাগ তো দূরের গ্রহ। স্রেফ পারস্পরিক প্রয়োজনে ‘লিভ ইন’। সম্পর্কের শিকড়ে কেবল রাজনীতি, সামাজিক কর্তৃত্ব ও ভাগীদারির ইতিকথা। তবু পড়শির সে দিনও ঘুম ছিল না। আজও নেই। উত্তরপ্রদেশের দেহাত থেকে দিল্লির দরবারে ‘গসিপ’ পৌঁছে গিয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু সত্যিটা কী? মাত্র পাঁচ বছরেই ব্রাহ্মণকুল, তামাম সবর্ণ মায়াবতীর ওপর বীতশ্রদ্ধ? না মানিয়ে-গুছিয়ে নিলেই সম্পর্ক ফের টিকে যেতে পারে আরও পাঁচ বছর।
তার অনুসন্ধানে বারাণসীর দশাশ্বমেধ ঘাট বা এই ইলাহাবাদের প্রয়াগ ছাড়া উৎকৃষ্ট স্থান আর কী-ই বা হতে পারে। উত্তরপ্রদেশের বহু প্রজন্মের সব পণ্ডিতদের বাস এখানে। কট্টর, গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদ ও সংস্কৃত পঠনপাঠনের পীঠস্থান। সবর্ণ স্বাভিমানের জমি কাশী-প্রয়াগ। আজ সেই প্রয়াগই জানাল, এ বার সতীশ-গিরীশে বনিবনা হচ্ছে না। ঝুসি থেকে গঙ্গার ওপর সেতু পেরোতেই দেখা যায় মাঘ মেলার বাঁশ-খুঁটি এখনও পড়ে রয়েছে। সঙ্গমের আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিছু তাঁবু। সামনের বছর এখানেই হবে মহাকুম্ভ।
প্রয়াগেই দেখা হল, কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণ সমাজের সাধারণ সম্পাদক রাজারাম শুক্লের সঙ্গে। জানালাম, বারাণসীতে দেখেছি মায়াবতীর ব্রাহ্মণ সেনাপতি ও তাঁর রাজনৈতিক উপদেষ্টা সতীশচন্দ্র মিশ্রের সভা হচ্ছে। বসপা-র কিছু ক্যাডার ভিন্ন উপস্থিতি নগণ্য। সে কথা শুনে শুক্ল জানিয়ে দিলেন, “মানুষ যাবে কেন? এই পাঁচ বছরে কোথায় ছিলেন মিশ্রজি? বহেনজির সেবা ছাড়া তিনি আর কী-ই বা করেছেন শুনি।” আর ইলাহাবাদ শহরে তাঁর বাড়িতে বসে কান্যকুব্জের সভাপতি গিরীশ চন্দ্রের বক্তব্য, “সতীশ মিশ্র ইলাহাবাদের সভায় পই পই করে ডেকেছিলেন। আমি যাইনি। আর ঠকতে চাই না।”
বারাণসীর ময়দাগিন, সিগরা, গোদোলিয়ার গলি তস্য গলিতে কার্যত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদেরই বাস। বিশ্বনাথ মন্দিরের পুরোহিত রামানন্দ তিওয়ারির দাবিটা অন্য রকম। মায়াবতীর কাছে দাবি ছিল, “পুরোহিতদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হোক। তাঁদের পঠনপাঠন শুরু হোক। পুজোর দক্ষিণা বেঁধে দিক সরকার। তা নয়, যত ভুয়ো ব্রাহ্মণ ঢুকে ওং বং কী মন্ত্র পড়ছে কে জানে?” মহা মৃত্যুঞ্জয় মন্দিরের প্রধান পুরোহিত কৈলাস দত্ত দীক্ষিতের রাগ অনন্য “সক্কাল সক্কাল স্নানধান করে পুজো করতে আসি। গেটে দাঁড়িয়ে পুলিশ সারা শরীর হাতড়ে প্রতিদিন কী যে ছাতা খোঁঁজে! শুচি-অশুচির বালাই নেই। নিরাপত্তার নামে এত বাড়াবাড়ি কেন বাবু?” সংস্কৃত পঠনপাঠনের গরিমা ‘চুলোয় গেল’ বলে সঙ্কটমোচন মন্দিরের প্রভাকর মিশ্রের অসন্তো•সেই কবে থেকে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ।”
উত্তরপ্রদেশ বিধান পরিষদে শিক্ষক গোষ্ঠীর প্রধান ওমপ্রকাশ শর্মার সঙ্গে লখনউয়ে কথা হয়েছিল। তাঁর মতে অবশ্য এগুলো ক্ষুদ্র বিষয়। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিককে ধরতে পারলেই সমস্যার মূল এবং এ বার ব্রাহ্মণ-উচ্চবর্ণের মতি ও গতি বোঝা যেতে পারে। তা কী সেই ইতিহাস ও সাম্প্রতিক?
ইলাহাবাদের ফুলপুর থেকে জয়ী হতেন জওহরলাল নেহরু। দেশ ভাগের পর যখন সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে ক্লিষ্ট পরিবেশ, তখন বহুত্ববাদের দাওয়াই দিয়েছিলেন তিনি। সম্প্রীতির সেই আবহে সাম্প্রদায়িক স্পর্শকাতরতার ঊর্ধ্বে ছিল উত্তরপ্রদেশ। তা যেমন ঠিক, তেমনই এ-ও ঠিক যে গোড়া থেকে ব্রাহ্মণ সমাজই উত্তরপ্রদেশ নিয়ন্ত্রণ করেছে। হেমবতীনন্দন বহুগুণা, কমলাপতি ত্রিপাঠীর মতো ব্যক্তিত্ব ছিলেন অন্যতম। বৈশ্যদের মধ্যে ছিলেন সি বি গুপ্ত। সবর্ণ প্রতাপ ছিল প্রশাসনে। আমলাতন্ত্র, বিচারবিভাগ সর্বত্র। মিশ্র, শুক্ল, ত্রিপাঠী, তিওয়ারীরাই ‘রাজ’ করেছেন।
রাম মন্দির আন্দোলনের আগে পর্যন্ত তাঁরা কংগ্রেসের সঙ্গেই ছিলেন। আবার মহাত্মা গাঁধীর কারণে তখন দলিতরাও ছিলেন কংগ্রেসের সঙ্গে। কিন্তু মন্দির আন্দোলন নয়া সমীকরণ গড়ল। হিন্দু আবেগের স্রোতে গা ভাসিয়ে উচ্চবর্ণের বড় অংশ চলে গিয়েছিল বিজেপিতে। অথচ ২০০৭ সালে ‘বিভ্রান্ত’ বিজেপি-কে দেখেও হতাশ হলেন তাঁরা। সেই মওকা বুঝেই তাঁর বহুজন-রাজনীতিতে সর্বজনের জামা পরিয়েছিলেন মায়া। মুলায়মকে জব্দ করতে স্রেফ ‘মজবুরিতে’ তা মেনেও নিলেন সবর্ণরা। কিন্তু তাতেও তো মোহভঙ্গই হল।
শর্মা প্রশ্ন তুলছেন, “মায়াবতী কথা রাখলেন কই? শুধু ক’জনকে মন্ত্রী করলেই হয়ে গেল! বারাণসীর ঘাট, প্রয়াগের সংস্কার হয়েছে? ‘জিসকে জিতনি ভাগীদারি, উনকে উতনি হিসসেদারি’ কোথায় পালন হচ্ছে? সিদ্ধান্ত গ্রহণে উচ্চবর্ণের ভূমিকা কোথায়?”
তা হলে প্রয়াগ-কাশীতে ব্রাহ্মণদের যাত্রা কোন দিকে? ওমপ্রকাশ শর্মার মতে, অধিকাংশই যাবে কংগ্রেসের দিকে। গোড়ায় যেখানে ছিলেন তাঁরা। কারণ এত দিনে বৃত্ত সম্পূর্ণ। কিন্তু বারাণসী এবং ইলাহাবাদের পাঁচ মিশেলি প্রতিক্রিয়া শুনে শর্মার মত এক কথায় গ্রহণ করা মুশকিল। বরং বারাণসীতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাঘবেন্দ্র চাড্ডার বক্তব্য, বিজেপি এ বার ভাল প্রার্থী দিয়েছে। যতটা সম্ভব ততটাই। কংগ্রেসও প্রায় সে রকমই। ফলে উচ্চবর্ণের ভোট নিয়ে এ বার টানাটানি হবে জাতীয় স্তরের দুই যুযুধান দলে। যদিও উচ্চবর্ণের এ-ও ক্ষোভ, কংগ্রেস সংখ্যালঘু ও দলিত নিয়ে ব্যস্ত। এমনকী কমলাপতি ত্রিপাঠীর নাতিকে টিকিট পেতে গিয়ে ঘাম ছোটাতে হয়েছে। আর বিজেপি তো ধরেই নিয়েছে যে ব্রাহ্মণ বিজেপি-র গেঁয়ো যোগী। তাই কুশওয়াহা, উমা ভারতীকে নিয়ে নাচানাচি করছে। তা সত্ত্বেও গত্যন্তরই বা কী আছে! তবে মায়াবতী দমে গিয়েছেন তা নয়। এ বার গত বারের তুলনায় বেশি সবর্ণ প্রার্থী দিয়েছেন। কৌশলটা এই যে, তাঁর দলিত ভোট তো সেই প্রার্থী পাবেনই, সেই সঙ্গে প্রার্থীর গুণে যদি কিছু উচ্চবর্ণের ভোট পাওয়া যায়, তা হলে সোনায় সোহাগা।
আপাতত বৃহদচিত্রটা মোটামুটি এ রকম। প্রকৃত ছবি অবশ্যই জানা যাবে ভোটযন্ত্র খোলার পরে। দেখা যাক, তখন মায়াবতী হাসবেন না কি পড়শিরা!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.