কয়েক দিন আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, ‘সিন্ডিকেট’ করা চলবে না। তৃণমূলের কেউ এর সঙ্গে যুক্ত থাকলে তার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়ে রেখেছেন তিনি।
রাজারহাট-নিউটাউনের সাইফুল ইসলাম মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রীর সেই নির্দেশ মানছেন কি?
সাইফুলের প্রথম পরিচয়: তিনি রাজারহাট-বিষ্ণুপুর ১ নম্বর পঞ্চায়েতের উপপ্রধান। এলাকার ‘দাপুটে’ তৃণমূল নেতা। আর দ্বিতীয় পরিচয়: তিনি রাজারহাট-নিউটাউনের অন্যতম বড় সমবায়-সিন্ডিকেটের কর্তা। তাঁর সমবায়ের নাম নবদিশা। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরেও সাইফুল বহাল তবিয়তে ‘দু’দিকই’ সামলাচ্ছেন বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ।
নিউটাউনের নবাবপুরে নবদিশার কার্যালয়। তার অধীনে রয়েছে প্রায় ৩৫টি সিন্ডিকেট। হিডকো এলাকা এবং রাজারহাট তার অধীনে। শুধু তাই নয়, গোপালপুর-কেষ্টপুর-বাগুইআটি-কৈখালি অঞ্চলেও যে সব সিন্ডিকেট রয়েছে, তার অধিকাংশের নিয়ন্ত্রণ সাইফুলেরই হাতে। তাঁর ‘একচ্ছত্র’ দাপটে ওই তল্লাটে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়!
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, বছর পঁয়তাল্লিশের সাইফুল পাঁচ বছর আগেও কার্যত বেকার ছিলেন। তাঁর সঙ্গী মোস্তাকিন হাজরা বাড়ি-বাড়ি ঘুরে ভাঙাচোরা প্লাস্টিক কিনে বিক্রি করতেন। পুলিশ জানাচ্ছে, বাম জমানায় যেমন গৌর ও লুইস নামে দুই সমাজবিরোধী (দু’জনেই এখন জেলে) এলাকা ‘শাসন’ করত, তেমনই নতুন সরকারের আমলে ‘রাজ’ করছে সাইফুল-মোস্তাকিন জুটি। এলাকাবাসীদের দাবি, সাইফুলের ‘সাম্রাজ্য’ ধরে রেখেছে সিন্ডিকেটেরই লোকজন। তাদের জন্য দেদার রোজগার আর আনন্দ-ফুর্তির ঢালাও বন্দোবস্ত করে রেখেছেন সাইফুল।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, সপ্তাহ আড়াই আগেই এলাহি আয়োজনের নমুনা দেখা গিয়েছে। এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছিল বিশাল বিশাল তোরণ। রাস্তার দু’ধারে বসেছিল অতিকায় সব হোর্ডিং। যাতে লেখা ছিল: দশ দিন ধরে ‘বিশাল ফ্যামিলি মিট’-এর আয়োজন করছে নবদিশা। খানাপিনার সঙ্গে জলসাও চলবে। গান গাইবেন মুম্বইয়ের নামী-দামি শিল্পীরা। অনুষ্ঠানে তৃণমূলের অনেক বিশিষ্ট নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমন্ত্রিত ছিলেন স্থানীয় তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারও।
কাকলিদেবী এখন উত্তরপ্রদেশে ভোট-প্রচারে ব্যস্ত। সেখান থেকে ফোনে তিনি বলেন, “আমি ওই অনুষ্ঠানে যাইনি। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী কিছু দিন আগেই জানিয়েছেন, দলীয় নেতা-কর্মীরা সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না। তার পরে প্রত্যেককেই সতর্ক করা হয়েছে। এর পরেও যদি কেউ সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, দল তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।” তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পর্যবেক্ষক তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও বলেন, “দলীয় নেত্রীই জানিয়েছেন সিন্ডিকেটে যুক্ত থাকলে দল করা যাবে না। কারও বিরুদ্ধে এমনঅভিযোগ উঠলে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
নিজের দলের সাংসদ-মন্ত্রীর এ হেন ‘ঘোষণা’ শুনেও সাইফুলের অবশ্য বিশেষ হেলদোল নেই। বরং তিনি বলছেন, “আমি নবদিশার বোর্ড অফ ডিরেক্টরস-এ রয়েছি। তাতে অসুবিধে কোথায়?” বরং তাঁর দাবি, “দীর্ঘ দিন ধরে একটা সিস্টেম চলছে। নতুন সরকার এসে তাকে বদলাতে গেলে সমস্যা হবে।”
কবে থেকে শুরু হল তথাকথিত এই ‘সিস্টেম’? বাম আমলে হিডকো জমি অধিগ্রহণ করার পরে জমিহারারাই তৈরি করেছিলেন সমবায়। কার্যত আজ যা সিন্ডিকেটে পরিণত হয়েছে। সেগুলির বেশির ভাগ বামেদের দখলে থাকলেও কংগ্রেস এবং তৃণমূলের অধীনেও কিছু সিন্ডিকেট ছিল। লোকসভা ভোটে পালাবদলের পর থেকেই গৌর-লুইসের আধিপত্য ভেঙে গিয়ে সিন্ডিকেটগুলির অধিকাংশ সাইফুলদের হাতে চলে এসেছে। সিপিএমের জেলা সম্পাদক তথা রাজ্যের প্রাক্তন আবাসন মন্ত্রী তথা হিডকোর প্রাক্তন চেয়ারম্যান গৌতম দেব বলছেন, “মুখ্যমন্ত্রী তো জানেন যে দলের লোক সিন্ডিকেটে রয়েছে। সেই জন্যই তো তিনি বলেছেন, সিন্ডিকেট করলে দলে থাকা যাবে না। হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, নেতারা কেউ চাঁদা চাইলে দেবেন না।”
সাইফুল তা-ও প্রশ্ন ছুড়ছেন “তৃণমূল করলে কেউ সিন্ডিকেটে একেবারে থাকতে পারবে না, এটা কে বলেছে?” কেন, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীই তো বলেছেন! দলের ভাবমূর্তি নিয়ে খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই ‘চ্যালেঞ্জ’ জানিয়ে সাইফুল বলছেন, “দলের ভাবমূর্তি কী ভাবে রক্ষা করতে হয়, তা আমরাও জানি।”
কীসের জোরে এই চ্যালেঞ্জ? কারণ এই জমানায় সিন্ডিকেটগুলিতে ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে তিনটি গোষ্ঠী। সম্প্রতি কেষ্টপুরে তৃণমূল নেতা খুনে তৃণমূল নেতার গ্রেফতার সেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেরই পরিণতি। যেখানে দলীয় মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু এবং তাঁর অনুগামীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে দেখা গিয়েছে তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশকে। এখন সাইফুল যে ভাবে দলীয় নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ছেন, তার উৎসও সেই বৃহত্তর গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের মধ্যেই। আর কী অদ্ভুত সমাপতন! বাম আমলে গৌর-লুইসের নামে পুলিশের খাতায় তেমন কোনও অভিযোগ জমা পড়েনি। এই জমানাতেও সাইফুল-মোস্তাকিনের নামে পুলিশের কাছে অভিযোগ নেই বললেই চলে! তবে নিউটাউন থানা এলাকার জগদীশপুর-নইপুকুরের তৃণমূল সূত্রের খবর, সিন্ডিকেট নিয়ে বিবাদের জেরে সাইফুলদের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে এই ডিসেম্বরেই স্থানীয় কিছু মানুষ গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর কালীঘাটের বাড়িতে। নেত্রীর নির্দেশে বিষয়টি নিয়ে দলীয় স্তরে তদন্ত শুরু হয়। অভিযোগ, এর পরেই সাইফুলের ছেলেরা অভিযোগকারীদের উপরে চড়াও হয়। মারধরে জখম হন সাত জন। ওই ঘটনায় নিউটাউন ও রাজারহাট থানায় সাইফুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। কিন্তু সাইফুল বা তার দলবলের বিরুদ্ধে পুলিশ এখনও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ। কেন?
বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার বলেন “থানায় অভিযোগের পরে অসুবিধে হলে অভিযোগকারীরা বিষয়টি সরাসরি আমাকে জানাতে পারেন। ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” জগদীশপুর-নইপুকুরের বাসিন্দারা অবশ্য পুলিশকর্তার আশ্বাসে বিশেষ ভরসা পাচ্ছেন না। এঁদের অনেকেই তৃণমূল করেন। তা হলে ভয় কেন? এক তৃণমূল কর্মীর জবাব, “সাইফুলের পিছনে আছেন দলের এখানকার বড় বড় নেতা। তাঁরা দেখেও দেখেন না। পুলিশ আগে কিছু করে দেখাক। তার পর না হয় আমরা এগিয়ে আসব।” |