অধিবেশনের সময় ছাড়া বিধানসভায় সাংবাদিক সম্মেলন না-করার নির্দেশিকা ঘিরে সরকার ও বিরোধী পক্ষের সংঘাত আরও চড়ল। সরকার ‘ঈর্ষান্বিত’ হয়ে বিরোধীদের মুখ বন্ধ করতে চাইছে বলে বিধানসভার বাইরে রাস্তায় সোমবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে অভিযোগ করেছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র! পক্ষান্তরে, স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, তাঁর সিদ্ধান্তের প্রকাশ্যে সমালোচনা করে ‘অনৈতিক’ কাজ করছেন বিরোধী দলনেতা। সূর্যবাবুর পাল্টা দাবি, তাঁর ‘অধিকার’ এবং ‘বিবেক’ যা বলছে, তিনি তা-ই করছেন। সমাধানসূত্রের কোনও ইঙ্গিত এ দিন অন্তত পাওয়া যায়নি।
পূর্ব ঘোষণামতোই এ দিন তাঁর নির্দেশিকার প্রতিবাদ জানিয়ে স্পিকারকে চিঠি দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা। তাঁর বক্তব্য, “স্পিকারের এক্তিয়ার নিয়ে আমরা কোনও প্রশ্ন তুলছি না। ওই নির্দেশ প্রত্যাহারের দাবি করছি।” সূর্যবাবুর চিঠি পেলেও তা নিয়ে এ দিন বিশদে কোনও মন্তব্য করতে চাননি স্পিকার বিমানবাবু। তাঁর বক্তব্য, “বিরোধী দলনেতার চিঠি পেয়েছি। তবে চিঠিটা পড়া হয়নি। চিঠির ভাষাটা দেখতে হবে। পড়ার পরে আমার যা বলার, তা যিনি চিঠিটি পাঠিয়েছেন, তাঁকেই বলব।” |
তবে সূর্যবাবুর সমালোচনায় স্পিকার ‘ক্ষুব্ধ’। তিনি বলেন, “বিরোধী দলনেতা অনৈতিক কাজ করেছেন। আইন অনুসারে স্পিকারের কোনও নির্দেশ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও সমালোচনা করা যায় না।” তিনি বিধানসভায় ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ’ রক্ষা করতে চান বলেই স্পিকার এ দিন জানিয়েছেন। তাঁর কথায়, “উনি (সূর্যবাবু) ইচ্ছা করলেই আমাকে ফোন করতে পারতেন বা আমার ঘরে এসে কথা বলতে পারতেন। আমি তো সব সময়েই বিধানসভার পরিবেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ রাখতে চাই।” সূর্যবাবুর আবার পাল্টা বক্তব্য, সাংবাদিক সম্মেলনের জন্য বিধানসভার রীতি বা কাজে অসুবিধা হয়ে থাকলে স্পিকার তাঁর কাছ থেকে বিষয়টি জেনে নিতে পারতেন। কিন্তু সরাসরি নির্দেশিকা জারি করায় রাজনৈতিক দলগুলি ও সংবাদমাধ্যম, উভয় পক্ষেরই অধিকার ‘খর্ব’ হয়েছে।
জোট শরিকের তরফে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য অবশ্য এ দিন শুধু বলেছেন, “কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব রাজ্যের বাইরে রয়েছেন। তিনি ফিরেই পরিষদীয় দলের সঙ্গে বৈঠক করে এই বিষয়ে যা বলার বলবেন।”
বিধানসভার মিডিয়া সেন্টারে সাংবাদিক সম্মেলন করা যাবে না বলে এ দিন বিধানসভা ভবনের বাইরে অকল্যান্ড রোডে দাঁড়িয়ে সূর্যবাবু সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ওই জায়গায় রাস্তার ধারে তিনি আগেও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু বিধানসভায় নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষিতে এ দিনের ঘটনা অন্য তাৎপর্য পেয়েছে। প্রশ্নের জবাবে বিরোধী দলনেতা এ দিন বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী রুষ্ট হয়ে বলছেন, আমরা নাকি ওঁর প্রতি ঈর্ষা পোষণ করছি। আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই, মুখ্যমন্ত্রী এমন কোনও কাজ করেননি, যার জন্য ঈর্ষা করতে হবে! আমি যে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, সেটাই ঈর্ষার ব্যাপার সরকারের কাছে!”
তিনি কি প্রতিবাদ করে রাস্তায় সাংবাদিক সম্মেলন করলেন? বিরোধী দলনেতার জবাব, “এটা শুধু প্রতিবাদ নয়, বাধ্যবাধকতা। আর তো কোনও উপায় নেই! যত দিন না নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হবে, তত দিন রাস্তা বা অন্য কোথাও দাঁড়িয়ে বলতে হবে।” সূর্যবাবুর সাংবাদিক সম্মেলন চলাকালীন এ দিন টহলদারি টলছিল পুলিশের। রাস্তায় এ ভাবে সূর্যবাবুর সাংবাদিক সম্মেলন নিয়ে প্রশ্নের জবাবে স্পিকার বলেন, “উনি যদি বিধানসভার বাইরে কথা বলেন, তা নিয়ে আমার কী বলার আছে!”
স্পিকারের সমালোচনা করায় সূর্যকান্তবাবু বিধানসভার স্বাধিকার ভঙ্গ করেছেন বলে শাসক দলের একাংশের অভিমত। তৃণমূল পরিষদীয় দলের দুই শীর্ষ নেতা এ দিন জানিয়েছেন, সূর্যবাবুর বিরুদ্ধে স্বাধিকার ভঙ্গের নোটিস দেওয়ার বিষয়েও তাঁরা চিন্তাভাবনা করছেন। তবে বিধানসভার সূত্রের খবর, কেন তিনি ‘নির্দেশ’ দিয়েছেন, তা স্পিকার সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে জানাতেও পারেন। অধিবেশন যখন হয় না, তখন বিরোধী দলের সাংবাদিক বৈঠক করার বিষয়ে দেশের বিভিন্ন বিধানসভায় কী করা হয়, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সর্বদল বৈঠক হলে তাঁরা যোগ দেবেন বলে সূর্যবাবু জানিয়ে রেখেছেন। তবে তিনি বলেছেন, “স্পিকারের এক্তিয়ার নিয়ে কোনও প্রশ্ন তুলিনি। বিধানসভার পাঁচিলের ভিতরে তাঁর এক্তিয়ার আছে। রাষ্ট্রপতির তো জরুরি অবস্থা জারির এক্তিয়ার আছে! সেই এক্তিয়ার নিয়ে কি কেউ কিছু বলে? এমন সিদ্ধান্তের পিছনে সরকারের কী ভূমিকা, সেটাই দেখতে চাইছি।” স্পিকার বলছেন, তাঁর সিদ্ধান্তের প্রকাশ্যে সমালোচনা করা যায় না। বিরোধী দলনেতার দাবি, “আমার তা মনে হয় না। সংবিধান আমরা সবাই জানি। তার চেয়েও বড় কথা, বিবেক যা বলছে, তা-ই নির্ভয়ে বলছি। এই অধিকার আমার আছে।” |