লোকপাল বিলের পর ফের রাজ্যের অধিকার নিয়ে সরব হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার তাঁর আপত্তি জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র নিয়ে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুক্তি, জাতীয় সন্ত্রাস দমন কেন্দ্র বা ন্যাশনাল কাউন্টার টেররিজম সেন্টার (এনসিটিসি)-এর ব্যাপারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক যে নীতি নিয়েছে, তাতে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ রয়েছে। তাই রাজ্য এই নীতি মানবে না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে রাজ্যের এই আপত্তি সোমবারই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন করা হলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের শীর্ষসূত্রে জানানো হয়, রাজ্যগুলি এ ধরনের আপত্তির কথা তুলবে এটা মাথায় রেখেই এনসিটিসি-র মধ্যে একটি ‘স্থায়ী পরিষদ’ তৈরির কথা গোড়া থেকেই বলা হয়েছে। ওই পরিষদে এনসিটিসি-র প্রধান ছাড়াও সমস্ত রাজ্যের সন্ত্রাসদমন বাহিনীর প্রধানরা থাকবেন। ফলে কোনও রাজ্যে অভিযান হলে, সেই রাজ্যের সন্ত্রাস দমন বাহিনীর কর্তা আগেই বিষয়টি জানবেন। তাই রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপের যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা ঠিক নয়।
২০০৮ সালে ২৬/১১-র মুম্বই-হামলার পর সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় এনসিটিসি-র মতো একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সংস্থা তৈরির প্রস্তাব দেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম। পরিকল্পনা ছিল, সন্ত্রাসবাদী হামলার আগাম গোয়েন্দা-তথ্য সংগ্রহ, হামলার পাল্টা মোকাবিলা এবং তার তদন্ত, এই তিনটি দায়িত্বই একটি সংস্থাকে দেওয়া হবে। অন্যান্য সংস্থাগুলিকে এর ছাতার তলায় নিয়ে আসা হবে। এই নিয়ে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর এক সপ্তাহ আগে সরকারি নির্দেশিকা জারি করেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। আগামী ১ মার্চ থেকে এনসিটিসি কাজ শুরু করবে। পশ্চিমবঙ্গের অভিযোগ, এমন একটি সংস্থা তৈরির আগে কোনও রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করেনি কেন্দ্র। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পাল্টা যুক্তি, আপাতত সরকারি নির্দেশিকা জারি করে এনসিটিসি কাজ শুরু করছে। এ দেশে এই ধরনের সংস্থা আগে হয়নি। কাজেই এনসিটিসি কাজ শুরু করার পরে কোথায় অসুবিধা হচ্ছে, তা বোঝা যাবে। রাজ্যগুলি কোনও আপত্তি তুললে, তা খোলা মনে খতিয়ে দেখার আশ্বাসও দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তাদের বক্তব্য, সেই অনুযায়ী এনসিটিসি-র ক্ষমতার অদলবদল করে একে একটি সামগ্রিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা হবে। প্রয়োজনে পরে পৃথক আইন করে এনসিটিসি-কে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
কোথায় আপত্তি তুলছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার? রাজ্যের অভিযোগ, ইউএপিএ আইনে কোনও সন্ত্রাসবাদীকে পাকড়াও করতে এনসিটিসি যে কোনও রাজ্যে অভিযান চালাতে পারবে, সন্দেহভাজন বলে যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারবে এবং রাজ্যের যে কোনও পুলিশ বাহিনীকে নিজেদের প্রয়োজন মতো কাজে লাগাতে পারবে। অথচ এ জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের কোনও অনুমতির প্রয়োজন হবে না। রাজ্যের এক মুখপাত্র জানান, আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়। অথচ রাজ্যের অনুমতি ছাড়াই সেখানে হস্তক্ষেপ করতে চাইছে কেন্দ্র। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এটা কখনওই মেনে নেওয়া যায় না। রাজ্যের এক মুখপাত্রের কথায়, “কেন্দ্র চাইলে তার ইচ্ছামতো কোনও ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে এনসিটিসি-র মাধ্যমে দমনমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে।” রাজ্য যে এটা মানবে না, তা এ দিনের চিঠিতে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রশ্ন তুলেই সংসদে লোকপাল বিলের বিরোধিতা করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। তার জেরে শীতকালীন অধিবেশনে মনমোহন-সরকার বিল পাশ করাতে পারেনি। এখন ইউপিএ-র প্রধান শরিকের আপত্তিতে কি সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলাতেও বাধা পড়তে চলেছে? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা বলছেন, এনসিটিসি তৈরির উদ্দেশ্যে রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা নয়, কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো। এনসিটিসি-র স্থায়ী পরিষদে পশ্চিমবঙ্গের ‘কাউন্টার ইনসার্জেন্সি ফোর্স’-এর প্রধানও থাকছেন। একই ভাবে অন্য রাজ্যগুলির সন্ত্রাস দমন বাহিনীর কর্তারাও থাকবেন। কাজেই কোনও রাজ্যে অভিযান হলে, তাঁরা আগেই জানবেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের বক্তব্য, এনসিটিসি-র মূল কাজ হবে সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় কেন্দ্র ও রাজ্যের বিভিন্ন পুলিশ বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা-তদন্তকারী সংস্থাগুলির মধ্যে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে যাতে কোনও ফাঁক না থাকে, তা সুনিশ্চিত করা। রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ নয়। |