দরকার নিজের চিকিৎসার প্রতি আস্থা ও সাহস। রোগীর প্রতি নিয়মিত নজর রাখা।
মালদহ হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড ঘুরে এসে লিখছেন শিশু চিকিৎসক
কমলেন্দু চক্রবর্তী |
মালদহ হাসপাতালে শিশুমৃত্যু নিয়ে টিভি চ্যানেলে যে আলোচনা হচ্ছিল, তাতে বিরক্ত হয়ে টি ভি বন্ধ করে শুয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু সারা রাত ছটফট করতে হল। এক জন শিশু চিকিৎসক হয়ে ওই মৃত্যুগুলো কিছুতেই দূরে ঠেলতে পারলাম না। সকালে ঠিক করলাম, একা যাব মালদহ হাসপাতালে। নিজের তরফে, নিজের গরজে, বোঝার চেষ্টা করে দেখব, কী করে মারা গেল শিশুরা।
কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম, সকাল এগারোটা নাগাদ মালদা হাসপাতালে পৌঁছনো গেল। ঢুকেই বুঝলাম, আর যাই হোক এটাকে হাসপাতাল চত্ত্বর বলা যায় না। একটা বিশৃঙ্খল মাছের বাজার। নতুন কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছে। যেখানে সেখানে ইট বালির স্তূপ। ঘুরে বেড়াচ্ছে কনস্ট্রাকশনের যন্ত্র-গাড়ি। রাস্তা বলতে কিছু নেই যা আছে তাতে যথেষ্ট ভাবে দাঁড়িয়ে ভাড়ার গাড়ি, প্রাইভেট গাড়ি, ঠেলা গাড়ি। আর চলছে যথেচ্ছ হর্নের আওয়াজ, চিৎকার, গালাগালি।
হাসপাতালে ক্যাম্পাসের ভিতর মেইন বিল্ডিং-এর রাস্তা বলতে গাড়িগুলোর গুঁতোগুতি করার জন্য ১০-১২ ফুট ফাঁক রেখে সাজানো দোকান। যথেচ্ছ প্লাস্টিক টাঙানো। যে যেখানে পেরেছে বসে পড়েছে। গাড়ি আর দোকানের অত্যাচার দেখেই বোঝা যায়, এই হাসপাতাল একেবারে অভিভাবকহীন। গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে কানে এল, ‘হ্যাঁ, গাড়ি নিয়ে এল, আধঘন্টা থাকবে তারপর বেরিয়ে যাবে। ডাক্তাররা ভালই চালাচ্ছে।’ |
আরোগ্য নিকেতন? এ রাজ্যের হাসপাতালগুলি যেন অভিভাবকহীন। |
ঢুকলাম মেইন গেট দিয়ে। করিডোর? এ যেন কলকাতার ঘিঞ্জি এলাকার ফুটপাথ। লোকজন যেখানে সেখানে যেমন খুশি যাচ্ছে আসছে, এ ওকে ধাক্কা মারছে। কিন্তু ঘন ঘন চলছে ছোট ছোট দলে অস্ত্র-সহ পুলিশ। যেন ভিতরে আতঙ্কবাদী রয়েছে, তাদের ভয় দেখাতে টহল চলছে। ‘হসপিটাল এনভায়রনমেন্ট’ তো নয়, ‘হস্টাইল এনভায়রনমেন্ট।’ এখানে আর যাই হোক সেবা দেওয়া বা নেওয়ার মনোভাব কারও থাকার কথা নয়।
কথা বলে গিয়েছিলাম প্রিন্সিপালের সঙ্গে। তাঁর কথা মতো সেই ডাক্তারবাবুর খোঁজ নিলাম, যাঁর তত্ত্বাবধানে শিশুমৃত্যুর ঘটনাগুলি ঘটেছে। শুলাম উনিই হাসপাতালে আসেননি। অগত্যা নিজেই উদ্যোগ নিয়ে একজন হাসপাতালের স্টাফকে ধরে শিশুদের ডাক্তারদের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনজন জাক্তারের সঙ্গে কথা বললাম। দেখলাম ওয়ার্ডগুলো। গেলাম সেই ওয়ার্ডে যা আজকের দিনের খবরের শিরোনাম। কথা বললাম ডাক্তারের সঙ্গে।
ডাক্তারদের কথার সারমর্ম ছিল এমন: এখানে কোনও সমস্যা নেই। সমস্যাটা শুধু মিডিয়ার তৈরি।
এত সংখ্যায় অসুস্থ বাচ্চা (নবজাতক) ভর্তি হলে কিছু তো মারা যাবেই। শুধু মালদার শিশুরাই এখানে আসে না, ঝাড়খণ্ড, এমনকী বিহার থেকেও অসুস্থ বাচ্চা আসে। অনেক বাচ্চাই যখন হাসপাতালে আসে, তখন তারা মৃত, কিন্তু চাপে পড়ে তাদের ভর্তি নিতে হয়, ডেথ সার্টিফিকেট দিতে হয়। খাতায়-কলমে মৃতের সংখ্যা বেড়ে যায়।
কম বয়সী, অপুষ্ট, অত্যধিক সংখ্যায় শিশুর জন্ম দেওয়ার ফলে মায়ের শরীর এবং শিশুর স্বাস্থ্য অবশ্যই খারাপ হবে।
ভারতের অন্যান্য হাসপাতালের শিশুমৃত্যুর সংখ্যার তুলনায় এই হাসপাতালের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি নয়, বরং কম।
এখানে যা যা চিকিৎসা করা হয় তা যেমন করা উচিত তেমনই করা হয়।
সরকারি ভাবে নির্দিষ্ট শয্যা যেখানে ৬৫ সেখানে রোগীর সংখ্যা ২০০-২৫০ ছাড়িয়ে যায়।
কম ওজনের শিশু বাঁচানো যায় না। প্রায় সমস্ত শিশুরই মৃত্যুর কারণ শ্বাসকষ্ট ও ফুসফুসের সমস্যাজনিত।
হাসপাতাল দেখেশুনে যা মনে হল, তা এই।
হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা সত্যিই খুব বেশি। তুলনায় ডাক্তার কম, বিশেষ করে নাসির্ং স্টাফ বেশ কম। কিন্তু কেবল সেটাকেই শিশুমৃত্যুর কারণ বলে ধরে নিলে ভুল হবে। কেন শিশুরা বিপন্ন হচ্ছে, সেই সমস্যার গভীরে কেউ যেতে চাইছেন না, বরং সমস্যাকে হালকা করে দেখছেন।
প্রথমত, ডাক্তারি শুধু ওষুধ, স্যালাইন আর অক্সিজেন দেওয়া নয়। ‘আরও কিছু’। এই ‘আরও কিছু’ মানে নিজের চিকিৎসার প্রতি আস্থা ও সাহস, নিয়মমাফিক কাজকর্মের বাইরে গিয়েও নতুন ভাবনাচিন্তা এবং কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। প্রত্যেক রোগীর প্রতি নিয়মিত নজর রাখা। এই ‘আরও কিছুর’ বড় অভাব হাসপাতালের কর্মীদের মধ্যে।
তার একটা প্রকাশ অতিরিক্ত যন্ত্র-নির্ভরতা। যতগুলো শিশু নবজাতক বিভাগে ভর্তি, সকলেই রয়েছে যন্ত্রের তলায়, যেন যন্ত্রেই সব কিছু করবে। যন্ত্র বলতে একটা করে রেডিয়েন্ট ওয়ার্মার। এই রেডিয়েন্ট ওয়ার্মার এমন গা ঘেঁষাঘেষি করে রাখা, যে বাচ্চার কাছে সরাসরি পৌঁছনোই প্রায় অসম্ভব। আমি নিজে চেষ্টা করেও পৌঁছতে পারিনি। বোঝাই যায় গ্লুকোজ, অক্সিজেন আর কিছু ইনজেকশন দিয়ে একেবারে যন্ত্রের তলায় রেখে দিতে পারলেই চিকিৎসাকার্য সম্পন্ন, এমনই মনে করা হচ্ছে। অথচ রেডিয়েন্ট ওয়ার্মারের গায়ে একটা কথা পরিষ্কার করে লেখা থাকে ‘ডোন্ট কিপ দ্য বেবি আনঅ্যাটেন্টেড’-- শিশুকে বেখেয়ালে ফেলে রেখো না। আসলে ‘রেডিয়েন্ট ওয়ার্মার’ এই গালভরা নামটার কাজ কিন্তু একটাই বাচ্চাকে গরমে রাখা। কিন্তু নিয়মিত বাচ্চার শরীরের তাপ লক্ষ না রাখলে গরম হতে হতে বাচ্চার ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে। কী করে তাঁরা সেই সম্ভাবনা এড়াচ্ছেন, সে বিষয়ে ডাক্তার বা সিস্টারদের কাছ থেকে খুব ভাল উত্তর পাইনি।
বরং যন্ত্রের এতটা প্রয়োজন সত্যিই রয়েছে কী না, সে প্রশ্ন গোটা বিশ্বেই করা হচ্ছে। শিশুকে গরম রাখার সবচাইতে ভাল উপায় হল মায়ের শরীরের সঙ্গে বাচ্চাকে লাগিয়ে রাখা, এটা গোটা বিশ্ব মেনে নিয়েছে। একে বলা হয় ‘ক্যাঙারু কেয়ার।’ এতে গরম করা ছাড়াও বাচ্চাদের যে কোনও অসুবিধা হলে সঙ্গে সঙ্গে মা বুঝতে পারে এবং সাহায্য চায়। যন্ত্র সে সুবিধা দিতে পারে না।
একটা ঘরে অনেকগুলি অসুস্থ শিশু থাকলে বেশ কয়েকজন নার্সিং স্টাফকে তাদের দেখাশোনার জন্য লেগে থাকতে হবে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু আমরা যতক্ষণ ছিলাম, কাউকেই বাচ্চার কাছে যেতে দেখলাম না। বরং অবাধে বাইরের লোক অসুস্থ বাচ্চার পাশে এসে বসে থাকছে, বাচ্চাদের ঘাটাঘাটি করছে। বাধা দেওয়ার কেউ নেই।
চিকিৎসার আর একটি দিকের প্রতি অমনোযোগ লক্ষ করলাম। তা হল খাদ্য। শিশুরা কী খায়, সে ব্যাপারে ডাক্তাররা কখনও বলছেন সবাই মায়ের দুধ খায়, খেতে না পারলে খাদ্য-নল Ryles tube পরিয়ে খাওয়ানো হয়। কিন্তু Ryles tube সাপ্লাই থাকে না (সেই মুহূর্তে একটাও ছিল না), তাই প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া গেল না। কেউ বললেন, গ্লুকোজ দেওয়া হয় শিরায়। আমি যখন বললাম যে ১০ শতাংশ গ্লুকোজ দিনের পর দিন চালালে শিশুর অপুষ্টি হবে, তখন কেউ কেউ বললেন, আমরা মায়ের দুধ বার করে খাওয়াই, কিন্তু সেই বলার মধ্যে কোনও জোর ছিল না। আমিও কোনও মাকে বসে দুধ গালতে দেখলাম না। যারা খুব অসুস্থ শিশু, তাদের জন্য মায়ের বুকের দুধ সংগ্রহ করে সরু নল দিয়ে খাওয়াতে হবে, শুধু ১০ শতাংশ গ্লুকোজ দিয়ে রাখলে চলবে না, এটা কিন্তু চিকিৎসার প্রধান কথা। সেটা ওই শিশু ওয়ার্ডে নিশ্চিত করা হচ্ছে, এমন মনে হল না।
শিশুরা কী খায়, হাসপাতাল স্টাফদের মধ্যে তার বিশেষ ধারণা নেই। সিস্টারদের বক্তব্য ডাক্তারবাবুরা যা বলেন, তাই ওঁরা করেন। আর ডাক্তারবাবুদের কাছে বারবার প্রশ্ন করেও জানা গেল না শিশুরা কী খায়। ওদের উত্তরটা অনেকটা এ রকম, শিশুদের যা খাওয়া উচিত, তাই খায়। কিন্তু কী সেটা? উত্তর নেই। বাচ্চারা যে মায়ের দুধ পাচ্ছে, সে দিকে নজর রাখছেন? উত্তর এল, সময় কোথায়? তবে কি মায়েরা কৌটোর দুধ বোতলে খাওয়াচ্ছেন? উত্তর: ‘সেটা কী করে বলব? কারও কাছে কৌটো-বোতল থাকতেই পারে।’ এক জন মাকে দেখাই গেল বোতলে দুধ খাওয়াতে।
নিজের উদ্যোগে এবং খরচে মালদহে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, নিজের চোখে বিষয়টি দেখা ও জানা। যেটুকু বুঝেছি, তাতে আমার এই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছে যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নানা সংকট সত্ত্বেও শিশুমৃত্যু প্রতিরোধের কাজে অনেক উন্নতি করার সাধ্য আমাদের আছে। সে কাজের সবটাই শিশু ওয়ার্ডে সীমাবদ্ধ নয়। হাসপাতাল চত্বর পরিষ্কার করা তার একটা দরকারি কাজ, আর একটা বিষয় জরুরি বিষয় চিকিৎসা ব্যবস্থার সব স্তরে নবজাতকের পরিচর্যার প্রাথমিক নিয়মগুলি শেখানো, স্তন্যপান নিশ্চিত করানোর বিষয়ে প্রশিক্ষণ। অন্য দিকে শিশুবিভাগে শৃঙ্খলা আনতে হবে। কমপক্ষে দু’জন ডাক্তারকে সারা দিন হাসপাতালে থাকতে হবে, প্রতিবার কল বুক দিয়ে অসুস্থ শিশুকে দেখার জন্য ডেকে আনার প্রথা বন্ধ করতে হবে। সকাল-সন্ধ্যা বুড়ি ছুঁয়ে গেলে চিকিৎসা হয় না। শিশুরোগীর লোকদের সঙ্গেও নিয়মিত কথা বলতে হবে।
জেলা হাসপাতালগুলোতে ডাক্তাররা নিজেদের মতো রোগী দেখেন ও চিকিৎসা করেন। কোনও বিশেষ ডাক্তারের দায়িত্বে গোটা বিভাগটি থাকে না। ফলে নিজেদের মধ্যে সমঝোতার অভাব থাকে। কোনও একজন ডাক্তারের উপর বিভাগ দেখাশোনার ভার না থাকলে কোথায় কী অসুবিধা, সে বিষয়ে কারও নজর থাকে না। সব কিছু ঠিক চলছে কি না, সেটা নিশ্চিত করবেন কে? অনেকগুলি শিশু একসঙ্গে মারা না গেলে কি সে প্রশ্ন উঠবে না? |