স্পষ্ট উত্তর দিক স্বাস্থ্য দফতর। অর্থহীন পরিসংখ্যান কপচানো বন্ধ করুন মন্ত্রী-আমলারা।
স্বাতী ভট্টাচার্য |
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাস্থ্য ভবনে সাংবাদিকদের ডেকে এনে বলেছেন, তাঁরা পড়াশোনা করেন না, তাই শিশুমৃত্যু নিয়ে ‘ধেই ধেই নৃত্য’ করছেন, পড়াশোনা থাকলে বুঝতেন, মৃত্যু আদৌ বাড়েনি। শিশুচিকিৎসায় এ রাজ্য কত এগিয়ে রয়েছে, তা বোঝাতে মুখ্যমন্ত্রী বেশ কিছু তথ্য দিয়েছেন সে দিন। সাংবাদিকদের ‘ক্লাস নিয়েছেন’ বলা চলে।
এর পর ‘ধরণী দ্বিধা হও’ বলে বাইপাসের একটা গভীর ফাটল খুঁজে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া কী-ই বা করার থাকে? কিন্তু এখন মরতেও ভয় হয় আবার কাকে হিসেব কষতে হবে, বাম জমানায় কত সাংবাদিক আত্মহত্যা করেছিল। তার চেয়ে পড়াশোনাই করা যাক।
গোড়াতেই ধন্দ। ‘চারের ক’ প্রশ্ন করে ‘পাঁচের গ’-এর উত্তর মিললে যেমন সব গুলিয়ে যায়। প্রশ্ন ছিল এই রকম, ‘অল্প কয়েক দিনের মধ্যে কলকাতার বি সি রায় হাসপাতালে মারা গিয়েছে ১২ শিশু, মালদা হাসপাতালে মারা গিয়েছে ৭৫ শিশু। তা হলে কি রাজ্যে শিশু চিকিৎসার হাল খারাপ?’ উত্তর এল, ‘আমাদের শিশুমৃত্যুর হার অন্য অনেক রাজ্যের চেয়ে ভাল।’ তাতে হল কী? ‘ইনফ্যান্ট মর্টালিটি রেট’ বা শিশুমৃত্যু হার (প্রতি এক হাজার শিশুর কত জন মরল) হল সার্বিক উন্নয়নের একটি সূচক। তা থেকে যা বোঝা যায় তা হল, বস্তুত রাজ্য (বা দেশ) উন্নয়নের পথে কতটা এগিয়েছে। ১৫২টি দেশের তথ্য নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, মাথাপিছু জাতীয় আয় যত বাড়বে, মেয়েদের নিরক্ষরতা যত কমবে, আর ধনী-গরিবে রোজগারের ফারাক যত কমবে, তত কমবে শিশুমৃত্যুর হার। গরিব দেশগুলোতে আর একটা জরুরি শর্ত হল, স্বাস্থ্যের জন্য সরকারি বরাদ্দ কতটা। সরকার স্বাস্থ্যের জন্য বেশি টাকা ঢাললে শিশুমৃত্যু হার কমছে। |
অসহায়ের আর্তনাদ। বাবা-মায়েদের যা যা অভিযোগ ছিল তার সবই কি অসার? |
রাজ্যে হাসপাতালগুলো যদি আগের চেয়ে ভাল কাজ করে, নিশ্চয়ই এমন বেশ কিছু মৃত্যু এড়ানো যাবে, যা আগে যেত না। কিন্তু তার জন্য শিশুমৃত্যুর হারে কতটা হেরফের হচ্ছে, আদৌ হচ্ছে কি না, বুঝব কী করে? এ রাজ্যে অনেক কারণে শিশুমৃত্যু কমে থাকতে পারে। হয়তো মেয়েদের সাক্ষরতা বাড়াই তার প্রধান কারণ, কিংবা হয়তো শিশুটির সামান্য সমস্যা হলেই আগের চেয়ে দ্রুত তাকে হাসপাতালে আনা হচ্ছে বলে মৃত্যুর ঝুঁকি কমে যাচ্ছে, হয়তো এখন বহু গরিব বাপ-মা সাধ্যাতিরিক্ত খরচ করেও শিশুকে প্রাইভেট ডাক্তারের চেম্বারে চিকিৎসা করান। আবার এমনও হতে পারে যে, সত্যিই সরকারি হাসপাতাল আগের চেয়ে আরও তৎপর হয়েছে বলে শিশুমৃত্যু কমছে। কোনটা ঠিক, তা নির্দিষ্ট করে বুঝতে যে বিশদ তথ্য-পরিসংখ্যান রাখা প্রয়োজন, এবং যে সব অঙ্ক কষা প্রয়োজন, তা কেউ করেনি। গোটা রাজ্যে হাসপাতালে শিশুমৃত্যুর নিয়মিত ‘অডিট’ পর্যন্ত হয় না। ফলে শিশুমৃত্যু হারের হ্রাসের ভিত্তিতে চিকিৎসার উন্নত মানের যে দাবি স্বাস্থ্য দফতর করতে চাইছে, তা করার অধিকার তার নেই।
পরিসংখ্যানের দরকারই বা কী? মৃত্যুহার বাড়ুক আর কমুক, ‘আমার সন্তানকে কেন বাঁচাতে পারলে না?’ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চিকিৎসক, হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী দায়বদ্ধ। ‘তিন শতাংশ ক্ষেত্রে এমন তো হবেই,’ এ কথা মৃত সন্তানের বাপ-মাকে বলা শুধু অমানবিক নয়, অযৌক্তিক। রাজ্যে শিশুমৃত্যুর হার ৩ শতাংশ হতে পারে, প্রতিটি পরিবারের কাছে সন্তানের মৃত্যু ১০০ শতাংশ ক্ষতি। কৈফিয়ত সে চাইবেই, সেটা তার অধিকার। যেহেতু প্রতিটি শিশুই জনসম্পদ, তাই জনসাধারণও কৈফিয়ত চাইবে। এটা বুঝতে পড়াশোনার দরকার নেই, দরকার কাণ্ডজ্ঞান। অন্তত সাংবাদিকরা সেটা হারাননি।
হাসপাতালের গুণপনার ব্যাখ্যা দিতে যে পরিসংখ্যান দেওয়া হচ্ছে, তা পড়েও হকচকিয়ে যেতে হয়। ‘অমুক রাজ্যের তমুক হাসপাতালে এত শিশু ভর্তি হয়েছিল, মারা গিয়েছে এত জন। আমাদের তো তার তুলনায় কম।’ এর মানে কী? ভিনরাজ্যে যেটা শিশুদের জন্য বিশেষ হাসপাতাল, যেখানে অতি-রুগ্ণ শিশুদেরকেই রেফার করা হচ্ছে, তার সঙ্গে মালদহের মতো জেলা হাসপাতালের শিশুমৃত্যুর সংখ্যার তুলনা করা চলে কী করে? ধরুন, কোনও জেলার হাসপাতাল যদি ভর্তি-হওয়া শিশুর অবস্থা সামান্য সংকটজনক মনে করলেই তাকে রেফার করে দেয় মেডিক্যাল কলেজে, সেই হাসপাতালে শিশুমৃত্যু হবে অনেক কম। তা হলে কি ধরে নিতে হবে, সে ভাল চিকিৎসা করছে? কেবল মৃত্যুর সংখ্যা দিয়ে হাসপাতালের মান বোঝা যায়?
হাসপাতালের কাজের মান কী করে বোঝা যায়, সে বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং নানা গবেষক দলের বক্তব্য এই রকম:
• মান-নিয়ন্ত্রকদের দ্বারা (যেমন, যাঁরা হাসপাতালকে লাইসেন্স দেন বা বাতিল করেন) হাসপাতাল পরিদর্শন।
• রোগীদের মতামতের সমীক্ষা।
• নিরপেক্ষ কোনও সংস্থার (যেমন যাঁরা হাসপাতালকে ‘অ্যাক্রেডিটেশন’ দেন) রিপোর্ট।
• হাসপাতালের নিজস্ব মূল্যায়ন।
পরিসংখ্যানও একটি পরিমাপ হতে পারে, কিন্তু সেখানে অনেকগুলি সতর্কতার শর্ত রয়েছে। রোগের বৈচিত্র এবং তীব্রতার হেরফেরকে হিসেবে তো নিতেই হবে, উপরন্তু চিকিৎসার ফল (outcome) থেকে সব সময়ে নির্দিষ্ট করা যায় না, কে কে খারাপ পরিষেবা দিচ্ছে।
সব চাইতে দরকারি কথা বোধহয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই সিদ্ধান্তটি: ‘মূল্যায়ন পদ্ধতির উদ্দেশ্য হওয়া দরকার হাসপাতালের উন্নতি, নানা হাসপাতালের তুলনা করার জন্য তার ব্যবহার নির্ভরযোগ্য নয়।’ (How can hospital performance be measured and monitored? WHO Regional Office for Europe’s Health Evidence Network, August 2003)
এ রাজ্যে আমরা দেখছি, একটিমাত্র পরিসংখ্যানকে (ভর্তি ও মৃত্যুর অনুপাত) ‘পরিমাপ’ বলে দেখানো হচ্ছে, এবং তার ব্যবহার করা হচ্ছে নানা রাজ্যের নানা স্তরের হাসপাতালের মধ্যে তুলনা করার জন্য। এ ভাবে কী প্রমাণ করা গেল? দিল্লি-মুম্বইয়ের হাসপাতালের থেকে আমাদের হাসপাতাল ভাল, বা মন্দ, কোনওটাই বলা যায় না। কারণ সেই এক তা বলতে গেলে যা যা জানার দরকার ছিল, তার প্রায় কিছুই কেউ জানে না। তবু ভাঙা বিস্কুটের মতো কিছু পরিসংখ্যান ছুড়ে দেওয়া হল সাংবাদিকদের দিকে এগুলো চিবোও বাছারা, অত চেঁচিয়ো না।
যে প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া যেত, সেগুলো এড়িয়ে গেল স্বাস্থ্য দফতর। মালদহের ৭৫টি শিশু কিংবা বি সি রায়ের ১২টি শিশুর কোনওটিকে বাঁচাবার কোনও উপায় ছিল না? অপুষ্ট শিশুর জন্য, কম-ওজনের শিশুর জন্য যে চিকিৎসা প্রয়োজন, তা কি তারা পেয়েছিল? তাদের প্রত্যেকের জন্য ওই হাসপাতালে যে সময়ে যে লোকদের যা যা করার কথা ছিল, তা সবই কি করা হয়েছে? ওদের বাবা-মায়েরা যে যে অভিযোগ করছে তার সবই যে অসার, তা কি খতিয়ে দেখা হয়েছে?
সম্ভবত সব সন্দেহ ফালতু নয়। রাজ্যের একটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের লেবার রুমে বসে কাজকর্ম দেখার সুযোগ হয়েছিল সম্প্রতি। সদ্যোজাত শিশুগুলিকে ডাক্তাররা এনে রাখছেন ‘ওয়ার্মার’ যন্ত্রটিতে, মুখে ‘সাকশান’-এর নল দিচ্ছেন। আগে সুইচ টেপা হয়নি বলে ওয়ার্মার গরম নেই, সাকশান-এর নলটি দেওয়াল ঘেঁষে উদোম ঝুলছিল। একই নল পর পর ঢুকছে নানা শিশুর মুখে। লেবার রুমের ছাদ থেকে লম্বা ঝুল, মায়েদের গায়ে আধময়লা কাপড়। একটি লম্বা ‘কট’-এ পাশাপাশি পাঁচ-ছ’টি সদ্যোজাত রয়েছে, একই কাপড়ে ঢাকা, এক জন পা ছুড়লে সবার গা থেকে কাপড় সরে যাচ্ছে। কারও মাথা ঢাকা নেই, অন্তত দু’জনের পা ঠাণ্ডায় নীল হয়ে যাচ্ছে। পাশেই তিন-চার জন সিনিয়র নার্সদিদি রয়েছেন, তাঁদের সম্পূর্ণ মনোযোগ মস্ত টেবিলে রাখা মস্ত মস্ত খাতায়। তিন-চারটি নতুন নার্স দৌড়ে বেড়াচ্ছে লেবার রুম, অবজার্ভেশন রুম, পোস্ট-অপারেশন রুমে। এর সবই কি অনিবার্য, অবধারিত ছিল?
যে কোনও সরকারি হাসপাতালে যে কোনও দিন দাঁড়িয়ে বলা চলে, ‘ভীষণ ভিড়, অসম্ভব চাপ।’ কিন্তু যে সদ্যোজাতগুলি মারা যায় তারা সবাই রোগীর চাপে মরে না। তাদের অনেকে মারা যায় হাসপাতালে অপরিচ্ছন্নতা সহ্য করা হয় বলে, যন্ত্র থাকলেও কাজে লাগানো হয় না বলে, অভিজ্ঞ নার্স রোগী না-ছুঁয়ে খাতা কোলে বসে থাকেন বলে। জেলা হাসপাতালগুলো দশটা-পাঁচটার বাইরে ডেলিভারি করায় না, রেফারাল-এর দীর্ঘ পথে গর্ভের শিশুর শ্বাসরোধ হতে থাকে। ডাক্তারদের কাজের মূল্যায়ন করার কোনও পদ্ধতি নেই। মূল্যায়ন হলেও করেন সেই সব ডাক্তার যাঁরা রোগীর তত্ত্বাবধানে ছিলেন। মায়েদের মৃত্যুর যে ‘অডিট’ শুরু হয়েছে প্রায় এক বছর, আজ অবধি তাতে ডাক্তার, নার্স বা অ্যানেস্থেটিস্টের কোনও গলদ ধরা পড়েনি, কোনও ব্লাড ব্যাঙ্কের কি মেডিক্যাল পরীক্ষার সমস্যা খুঁজে পাওয়া যায়নি। সব মৃত্যু ম্যানেজ হয়ে যায় হাসপাতালগুলোতে। ম্যানেজ হয় না মরা শিশুর বাপ-মা, মিডিয়া, পাবলিক। তারা কেঁদে-রেগে-বুক চাপড়ে ‘ধেই ধেই নৃত্য’ করতে থাকে।
মুখ্যমন্ত্রীকে অভিনন্দন, তাঁর পড়াশোনা তাঁকে ওই মূর্খদের তাচ্ছিল্য করতে শিখিয়েছে। |