প্রণয়ের সহিত প্রহারের সম্পর্ক বড় বিচিত্র। বাৎস্যায়নের রতিশাস্ত্রের পৃষ্ঠায় চোখ রাখিলে দেখা যাইবে, রতিকালে প্রণয়াবদ্ধ নরনারী পরস্পরের শরীরে আঘাত করিয়া থাকেন। রতিকালের সেই আঘাত নাকি সুখকর, প্রীতিজনক। আহত হইবার সুখ লইয়া নানা মনস্তাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণ চলিতে পারে। এই আঘাতের মাত্রা ছাড়াইয়া গেলে যে প্রাণহানি ঘটে তাহাও রতিশাস্ত্রকার জানাইয়াছেন। তবে সেই আঘাত এক, আর প্রেম আদায়ের জন্য কাহাকে আঘাত করা আর এক। প্রেমে পড়িতে ইচ্ছা করিতেছে না, প্রেম করিতে ইচ্ছা করিতেছে না, অথচ প্রেমপাগল ব্যক্তি তাহা আদায় করিয়াই ছাড়িবেন। প্রেম না দিলেই প্রহার। ইহা ভাবিবার কারণ নাই যে এমন ঘটনা কেবল হালে ঘটিতেছে। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হইয়া অ্যাসিড ছুড়িয়া মারা বা সদ্য মালদহে যাহা ঘটিয়াছে প্রত্যাখ্যাত হইয়া প্রেমিকার পিতাকে হত্যা করা এমন ঘটনা কেবল এ কালেই ঘটে না, সে কালেও ভিন্নরূপে ঘটিত। বীর্যবান রাজপুরুষরা তাঁহাদের ইচ্ছা ও সুবিধা অনুযায়ী বলপ্রয়োগ করিয়া নারীদের অপহরণ করিতেন। যিনি অপহরণ করিতেন, সর্বদা যে তিনি অপহৃতাকে বিবাহ করিতেন তাহাও নহে। যেমন ভীষ্ম, নিজে বিবাহ করিবার জন্য নহে, নিজ বংশধরদের জন্য স্বয়ম্বর সভা হইতে কন্যা হরণ করিয়াছিলেন। আবার নিরুপায় সমাজ অপহৃত কন্যাদের সামাজিক স্বীকৃতি প্রদানের জন্য বিবাহের কতকগুলি গোত্র নির্দেশ করিয়াছিল। অভিভাবকগণের অমতে বা তাঁহাদের প্রহার করিয়া কন্যা অপহরণ করিয়া বিবাহ রাক্ষস, পৈশাচ ইত্যাদি নামের বিবাহ হিসাবে গণ্য হইত। ভাবখানা এই যে, যাহা হইয়াছে, এ বার অন্তত মেয়েটিকে বাপু বিবাহ করো। এগুলি উত্তম বিবাহ হিসাবে গণ্য হইত না। পৈশাচ বা রাক্ষস বিবাহ প্রজাপতি বা গান্ধর্ব বিবাহের তুল্য নহে। মহাভারতে ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ কন্যা অপহরণ। অপহৃতা অম্বাই তো শিখণ্ডী রূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।
আধুনিক সমাজ প্রাচীন ভারতীয় সমাজের চাহিতে আলাদা। ইদানীং প্রেমে প্রত্যাখ্যাতরা যে প্রবল প্রহারপরায়ণ হইয়া উঠিতেছেন তাহার পশ্চাতে নানাবিধ কারণ রহিয়াছে। একদা ভিক্টোরীয় রুচিবাগীশ শুচিবায়ুগ্রস্ততার দাপটে বঙ্গসমাজে যে অবদমন অনিবার্য হইয়া উঠিয়াছিল ইদানীং তাহা কমিয়াছে। পুরুষপুঙ্গবেরা অনেক সময় সেই অবদমনের বিপরীতে প্রবল এক বেপরোয়া ভাব রপ্ত করিয়াছেন। হয় কথামতো প্রেম করো না হয় মার খাও। ইহা অভব্যতা, এবং এই অভব্যতা রোধ করিবার জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা লইতে হইবে। তবে আইন ও পুলিশগিরি এই হানিকর অভব্যতা দূর করিবার জন্য যথেষ্ট নহে। শিক্ষিত হইতে হইবে। মনে রাখিতে হইবে, নরনারীর সম্পর্ক স্থাপন কেবল তাৎক্ষণিক আবেগ হইতে সঞ্জাত নহে, তাহার পশ্চাতে মানসিক ও মানবিক শিক্ষা আবশ্যক। প্রেম বা ভালবাসার অর্থ বলপ্রয়োগ করা নহে। যে প্রকৃত প্রেমিক সে ছাড়িয়া দিতে জানে। অপরকে সম্মান দিতে পারে। অপরের ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য প্রদান করিবার সুশিক্ষা তাহার অধিগত। কাজেই কেহ যদি প্রত্যাখ্যান করে তাহা হইলে বলপ্রয়োগ করিতে নাই, নীরবে সরিয়া যাইতে হয়। কচলাইলে কিছুই পাওয়া যায় না। প্রেমের দিবস পালনের সংস্কৃতি ইদানীং বঙ্গদেশে চালু হইয়াছে। সংস্কৃতি শব্দের পশ্চাতে সংস্কার শব্দটি নিহিত রহিয়াছে। সংস্কার অর্থ শোধন। নিজেদের পৌরুষ ও অহঙ্কার শোধনের সময় আসিয়াছে। নিজেকে না শোধরাইলে সভ্য হওয়া যায় না, এই সত্যটি এই বসন্তে বঙ্গপুঙ্গবরা মনোযোগ সহকারে অনুধাবন করুন। |