লোকে মমতা ভাবছে শুনে লজ্জা পেলেন কাকলি
চিরঞ্জিতের গানেই উচ্ছ্বসিত বং-দুর্গ বারাণসী
‘আজ এই দিনটাকে মনের খাতায় লিখে’ রাখা ছাড়া আর কী করতে পারি বলুন!
রবিবার সন্ধ্যা। দশাশ্বমেধ ঘাটে ঠাসা ভিড়। শঙ্খ, ঘণ্টা, ভজনসঙ্গীতে মুখর। সন্ধ্যারতি শেষ না হতেই ঘাটের একটু আগে মাইকে খালি গলায় বাংলা গান। শোনামাত্র চমকে উঠলেন মাঝবয়সী দাদা। “কে গাইছেন বল তো?” পাশে বউদি। “আরে আমাদের চিরঞ্জিৎ গো। ফাটাফাটি-ই-ই।”
ভোট ভুলে যান। শুধু সিনটা ভাবুন। দশাশ্বমেধ ঘাটের অদূরে কোনও রকম একটা মঞ্চ। মানে পাতি তক্তপোষ, তার উপর শতরঞ্চি। আশপাশে কিছু তৃণমূলের পতাকা। শেষ বক্তৃতা করবেন তিনি। প্রথমে একটা রবীন্দ্রনাথ সঙ্গীত। তার পর বাপ্পি লাহিড়ী-কিশোর কুমার জুটির ওই কিম্বদন্তী গান। ছবির নাম অন্তরালে। গান শেষ। গাড়িতে ওঠার আগে ছেঁকে ধরেছে ভিড়। “দাদা ছাড়ব না। প্রতীকের ওই ডায়লগটা এক বার হাতের পাঞ্জা বড় হলেই মাস্তান হওয়া যায় না।”
দশাশ্বমেধ লজ ও তার আশপাশের ঝুলবারান্দা থেকে ঝুঁকে পড়েছে মানুষ। বাঙালিটোলা, গোদোলিয়ায় এমনিতে প্রচুর বাঙালি। দাশগুপ্তের জর্দা তো সেনেদের মিষ্টির দোকান। তার উপর বাঙালি ট্যুরিস্ট। ক্যামকর্ডারে মুহূর্ত বন্দি করে রাখছেন বিদেশিনী পর্যটক। এমন সন্ধ্যা দশাশ্বমেধ দেখেছে কখনও?
বারাণসীর পথে প্রচার তৃণমূলের। চিরঞ্জিৎ-কাকলি ঘোষদস্তিদারের সঙ্গে
প্রার্থী বাঁটুলবাবু (পিছনে বাঁদিকে)। — নিজস্ব চিত্র
পাশে বসে তাল দিচ্ছেন সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার। স্ত্রী-ও বসে আছেন কাছেই। উল্লসিত বাঁটুল-দা, “কী কাণ্ড মশাই, এ তো হইচই বেঁধে গেল। আমি তো জিতবই দেখছি। আর কে আটকায়?” বাঁটুলবাবু বারাণসী ক্যান্টনমেন্টে তৃণমূলের প্রার্থী। গত প্রায় দু’দশক ধরে বারাণসী পুরসভায় কংগ্রেস কাউন্সিলার। তৃণমূল উত্তরপ্রদেশে ভোটে লড়বে শুনেই যোগাযোগ করেছেন। কারণ কংগ্রেস তাঁকে টিকিট দেবে না। পুরো নাম শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু নাম জানতে চান, বলবেন শম্ভুনাথ বাঁটুল। মাথায় চুল রয়েছে। সেই সঙ্গে বেনারসী পণ্ডিত ঘরানার মতো মস্ত বড় একটা চটি। মানে টিকি।
ভোট ভুলে যান। কল্পনা করুন। বাঙালিটোলায়, চিত্তরঞ্জন পার্কে ছোটাছুটি পড়ে গিয়েছে। ওই তো সরু গলি! এমনিতে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। পরশু এখানেই কংগ্রেসের সভা দেখেছি। কিন্তু আজ একেবারেই অন্য রকম। গত কাল শিলিগুড়িতে শু্যটিং ছিল। সেখান থেকে রবিবার সকালে কলকাতায় ফিরেছেন। দুপুরে সস্ত্রীক বারাণসী। পরনে ব্লেজার। গলায় তৃণমূলের উত্তরীয়।
এখানেই কাট। এ বার পিছনে চলে যাই বিকেলের দৃশ্যে। তাজ গেটওয়ে হোটেল থেকে বেরোচ্ছেন তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার। সঙ্গে বাঁটুল-দা ও বারাণসীর আর এক প্রার্থী এস পি শ্রীবাস্তব। বারাণসীতে তৃণমূল কংগ্রেসের রোড শো হবে। পিছু নিলাম।
প্রদীপ হোটেল থেকে গাড়িতে উঠলেন চিরঞ্জিৎ। দুধ সাদা টাটা সাফারি। পিছনে তৃণমূলের পোস্টার। লখনউয়ে তৃণমূলের প্রার্থী অমিত চৌধুরির। এক দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি। অন্য দিকে অমিতের। মাঝে তৃণমূলের প্রতীক। নীচে লেখা জোড়া ফুল। আমার গাড়ির চালক প্রতাপ, পোস্টার পড়ে জানতে চাইলেন, “নির্দল তো?” ঈষৎ বকুনি দিয়ে বললাম, “আপনি না রাজনীতির এত খবর রাখেন! মন্ত্রীর চালক ছিলেন। তৃণমূলের নাম শোনেননি? রেলমন্ত্রী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।” “ওহ্ এ বার বুঝেছি। সামনের গাড়িতে যে ম্যাডাম বসে আছেন, তিনি তো!” প্রতাপের কথা ছাড়ুন। সাফারির চালক যে অভয়, তাঁর মাথায় তৃণমূলের টুপি। তাতে মমতার ছবি। কিন্তু তৃণমূল সম্পর্কে প্রশ্ন করলেই শুধু চেয়ে থাকেন।
গাড়ি তিন মাথার মোড়ে এসে পৌঁছল। সেখানে আগেই দাঁড়িয়ে ছিল একটি তিন চাকার টেম্পো। টাটা ম্যাক্সি ক্যাব। তৃণমূলের পতাকা লাগানো। সামনে গোটা কয়েক মোটর সাইকেলে কিছু যুবক। স্লোগান তুলছেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জিন্দাবাদ, কাকলি ঘোষ জিন্দাবাদ।” সবাই মিলে এ বার সেই টেম্পোয় চড়লেন। গাড়ি এগোতে লাগল।
ভোট ভুলে যান। দৃশ্যটা দেখুন। কাকলিদেবীর নিজের হাতেই মাইক। বারাসতে তাঁর হয়ে তৃণমূল কর্মীরা যে ভাবে প্রচার করেন, আজ নিজেই সেই ভূমিকায়। “তৃণমূল এ বার বারাণসীতে প্রার্থী দিয়েছে। মমতা দিদি যে রকম স্বচ্ছ প্রশাসন কায়েম করেছেন পশ্চিমবঙ্গে, তেমন উত্তরপ্রদেশেও হতে পারে।” কাকলি-চিরঞ্জিৎ উভয়েই পথচলতি মানুষ, দু’পাশের বাড়ি-দোকানের উদ্দেশে হাত নেড়ে চলেছেন। মোড়ের মাথায় জটলা পাল্টা হাত নেড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে।
গাড়ি থেকে নেমে বারবার ছুটে গেলাম সেখানে। কে বলুন তো? একটাই জবাব, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো! সাদা বুটি দেওয়া শাড়ি পড়া কাকলির মাথায় ঘোমটা। তা দেখেই হয়তো ভ্রম হচ্ছে। গাড়ি এ বার আই পি মলের কাছাকাছি এসে থেমেছে। বললাম, আপনাকে তো সবাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাবছেন। “এই যাঃ! কী যে বলেন!” লজ্জা পেলেন কাকলি।
দুপুরে মধ্যাহ্নভোজে তাঁর সঙ্গেই দীর্ঘ কথা হয়েছে। সবিস্তারে জানালেন, কী ভাবে প্রার্থী বাছা হয়েছে তৃণমূলের। জৌনপুর ফৈজাবাদ-সহ এক এক এলাকার পরিসংখ্যান মগজে। বাকি কিছু মোবাইলে। গত দু’মাস ধরে উত্তরপ্রদেশে ঘুরছেন। পরশু লখনউয়ে ঠান্ডা লেগে গিয়েছে। চোখ দিয়ে মাঝে মাঝে জল গড়াচ্ছে সে জন্য। উৎসাহে ঘাটতি নেই তবু। অনর্গল বলে যাচ্ছেন, কতগুলি আসন জিতবেন। আসনওয়াড়ি এতটা প্রত্যয় কংগ্রেস, বিজেপি কিংবা সমাজবাদী পার্টির মুখেও শোনা যায় না। কাকলিদেবীরা কাল যাবেন নয়ডা। ওই আসনটিও তৃণমূল পাবে বলে তাঁর দাবি।
সে নয় হল, কিন্তু তৃণমূলের টিকিট বিতরণ নিয়েও তো বিস্তর অভিযোগ। একশোর কাছাকাছি প্রার্থী মনোনয়নই জমা দিতে পারেননি। উত্তেজিত সাংসদের জবাব, “ওসব নিন্দুকেরা বলছে। বাজে কথা। কিছু প্রার্থী যে মনোনয়ন জমা দিতে পারেননি, তা নিয়ে কমিশনে নালিশ করেছি।”
আবার ফিরে আসি দশাশ্বমেধ ঘাটে। সভার আগে চিত্তরঞ্জন পার্কে পায়ে হেঁটে রোড শো হয়েছে। এখানে বাঙালিরা সবাই বাঁটুলবাবুকে চেনেন। আগে ওঁরা বিজেপি-র সাত বারের বিধায়ক শ্যামদেব রায়চৌধুরি ওরফে দাদা-র কেন্দ্রে ভোটার ছিলেন। আসন পুনর্বিন্যাসে সেখানকার তিরিশ হাজার বাঙালি ভোট এসেছে ক্যান্টনমেন্ট কেন্দ্রে।
জয়বাবা ফেলুনাথে ফেলুদার মন্তব্যে যা ‘বাঙালির দ্বিতীয় হোমল্যান্ড’, সেই বং-দুর্গে আজকের সভার পর যার পর নাই আহ্লাদিত বাঁটুলবাবু। সভা শেষে চা-সিঙ্গারার আড্ডায় চিরঞ্জিতের উদ্দেশে এক সাংবাদিকের মন্তব্য, “সব কিছুরই তো একটা শুরু থাকে। এই ধরুন উত্তরপ্রদেশে আপনারা প্রচার শুরু করলেন। শুরুর দিনটা নিশ্চয়ই আপনার মনে থাকবে।” এই রাজ্যে তৃণমূলের ভবিষ্যৎ নিয়ে এর আগে প্রশ্ন করা হলে চিরঞ্জিৎ তথা বিধায়ক দীপক চক্রবর্তী বলেছিলেন, “খুব উজ্জ্বল।” আর এখন বললেন, “কে বলতে পারে, এক দিন দেখবেন এই উত্তরপ্রদেশ থেকেই তৃণমূলের ২৫ জন সংসদে যাবেন।” ভোটের ফল যা-ই দাঁড়াক, দশাশ্বমেধে চিরঞ্জিতের গান থেকে শুরু করে হিন্দি বলয়ে পা রাখার এই স্বপ্ন সব মিলিয়ে তৃণমূলের মহরতটা কিন্তু মনে রাখার মতোই হয়ে রইল।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.