সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র আনার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল তাঁর। আজ গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধানের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ের মুখও সেই মহম্মদ ইফতিকার চৌধুরি পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক শিবির অবশ্য বলছে, পাকিস্তান পিপলস পার্টির সরকারের সঙ্গে প্রধান বিচারপতির এই সংঘাত হওয়ারই ছিল। দেশের নাগরিক সমাজের আন্দোলনের চাপে তাঁকে প্রধান বিচারপতির পদে ফেরাতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জারদারি। এবং ২০০৯ সালে তাঁর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ এক রায়ে জারদারির রক্ষাকবচটাই তুলে নিয়েছিল। মূলত পাকিস্তান পিপলস পার্টির সঙ্গে সমঝোতা করতে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফ বিরোধীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা বন্ধ করার জন্য যে অর্ডিন্যান্স জারি করেছিলেন, তা অসাংবিধানিক বলে রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। জারদারির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা ফের শুরু করার পথ তখনই খুলে গিয়েছিল। তার পর থেকে এ ব্যাপারে শীর্ষ আদালতের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রী গিলানি অগ্রাহ্য করে চলেন, যার পরিণতি আজকের চার্জশিট।
ইফতিকার চৌধুরি |
১৯৪৮ সালে বালুচিস্তানের কোয়েটায় জন্ম ইফতিকারের। তার আগের বছরই ভারতের পঞ্জাব থেকে বালুচিস্তানে যান তাঁর বাবা। প্রথমে বালুচিস্তানের অ্যাডভোকেট জেনারেল, পরে বালুচিস্তানের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হন ইফতিকার। তার পরেই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেন, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হওয়ার আগে পর্যন্ত ইফতিকার চৌধুরির নামের আগে বিতর্কিত বা বৈপ্লবিক, কোনও তকমাই বসেনি। প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরে যে মুশারফের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান ইফতিকার, সেই সামরিক শাসকই এক দিন তাঁকে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি নিয়োগ করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি-সহ বেশ কয়েক জন সামরিক শাসনের বিশেষ বিধি অনুযায়ী শপথ নিতে রাজি হননি। সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে ইফতিকারদের নিয়োগ। সেটা ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি। তারপর সেই সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ মুশারফের যাবতীয় অ-সাংবিধানিক কাজকে বৈধ বলে রায় দেয়।
প্রেসিডেন্ট মুশারফের সঙ্গে ইফতিকারের সংঘাত শুরু, ২০০৫ সালে তিনি প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিখোঁজ ব্যক্তিদের খতিয়ান চাওয়া বা পাকিস্তান স্টিল মিলস-কে ‘জলের দরে’ বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করে মুশারফের চক্ষুশূল হন তিনি। ২০০৭ সালের ৯ মার্চ ‘আর্মি হাউজ’-এ ডেকে পাঠিয়ে পাঁচ সেনাকর্তার সামনে তাঁকে পদত্যাগ করতে বলেন মুশারফ। প্রধান বিচারপতি মানেননি। তার পরে নজিরবিহীন ভাবেই তাঁকে সাসপেন্ড করার সুপারিশ ‘সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল’-এ পাঠান মুশারফ। কিন্তু এই প্রথম পাকিস্তানে কোনও সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান দেশের কোনও বিচারপতি। মুশারফের নির্দেশকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ করেন। সেই আইনি লড়াই ঘিরে আইনজীবী এবং নাগরিক সমাজের আন্দোলন দানা বাঁধে মুশারফের শাসনের বিরুদ্ধে। সুপ্রিম কোর্টে হারেন মুশারফ। রাতারাতি দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে ইফতিকারকে গৃহবন্দি করেন মুশারফ। তাতেই তাঁর পতনের শুরু। শেষে ২০০৮ সালের ২৪ মার্চ প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম দিনে ইউসুফ রাজা গিলানি ইফতিকারকে মুক্তি দেন। নতুন সরকারের সঙ্গে সংঘাতের শুরুও তখন। কারণ, প্রেসিডেন্ট জারদারি ইফতিকারকে পুরনো পদে নিয়োগের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু দেশ জুড়ে আইনজীবী এবং নাগরিক সমাজের ‘লং মার্চ’-এর কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হন জারদারি। সেটা ২০০৯ সালের মার্চ মাস। |