দেশের শীর্ষ আদালতে জোর ধাক্কা খেলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ ইউসুফ রাজা গিলানি। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির বিরুদ্ধে দুর্নীতি সংক্রান্ত পুরনো মামলা ফের শুরু না করায় গিলানির বিরুদ্ধেই মামলা শুরু করল পাক সুপ্রিম কোর্ট। আজ আদালতে হাজির প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিচারব্যবস্থাকে হেয় করার অভিযোগ এনে চার্জশিট পেশ করা হয়। দোষী সাব্যস্ত হলে প্রধানমন্ত্রী পদ তো বটেই, পার্লামেন্টের সদস্যপদও হারাবেন গিলানি। আর সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সংসদীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ ফের অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের আশঙ্কা।
সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে পাক
প্রধানমন্ত্রী। ছবি: রয়টার্স |
পাকিস্তানের ৬৪ বছরের গণতান্ত্রিক ও সামরিক শাসনের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিচারব্যবস্থাকে হেয় করার অভিযোগে চার্জশিট পেশ হল। আর এমনটা ঘটল সেই পাকিস্তানে, যেখানে মাত্র বছর চারেক আগেই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংঘাতের জেরে বরখাস্ত করা হয় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ইফতিকার মহম্মদ চৌধুরিকে। তখন বলা হয়েছিল, পাক বিচারব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করেছেন একনায়ক মুশারফ। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, বর্তমানে সেই ইফতিকারই পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি। আর মুশারফের জমানার অবসান ঘটিয়ে ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে যে ব্যক্তি ইফতিকার চৌধুরিকে প্রধান বিচারপতি পদে পুনর্বহাল করেন, সেই গিলানিই এখন অভিযুক্তের কাঠগড়ায়। ইসলামাবাদে বিচারপতি নাসির-উল-মুল্কের নেতৃত্বাধীন পাক সুপ্রিম কোর্টের ৭ বিচারপতি সংবলিত বিশেষ বেঞ্চ এ দিন জানিয়েছে, বারবার নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও পাক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির বিরুদ্ধে জমে থাকা দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলাগুলি চালু করতে রাজি হননি গিলানি। এমনকী, গত ১৯ জানুয়ারি আদালতে হাজিরা দিলেও দুর্নীতি মামলা নিয়ে সদুত্তর দেননি তিনি। জারদারির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, সুইস ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সরকারি টাকার বেআইনি লেনদেন করেছেন তিনি। তাই শীর্ষ আদালত চেয়েছিল, সেই সংক্রান্ত মামলা ফের চালু করতে অনুরোধ জানিয়ে সুইৎজারল্যান্ড সরকারকে চিঠি দিন পাক প্রধানমন্ত্রী। সেই নির্দেশ মানেননি গিলানি। যদিও এ দিনও নিজেকে নির্দোষ দাবি করে গিলানি জানান, দেশের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে সংবিধানেই প্রেসিডেন্ট জারদারির কিছু আইনি ‘রক্ষাকবচ’ রয়েছে। সেটা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি অগ্রাহ্য করতে পারেন না। গিলানির অভিযোগ, তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে পদক্ষেপ করা হচ্ছে। সংবিধান বহির্ভূত কোনও কাজ তিনি করেননি। শীর্ষ আদালতের সঙ্গে পুরোদস্তুর আইনি লড়াইয়ে যেতেও তিনি প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন গিলানি।
এমনিতেই মেমোগেট বিতর্ক ঘিরে পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাত চলছে প্রধানমন্ত্রীর। তার সঙ্গে যোগ হল আদালত অবমাননার মামলা। ফলে সব মিলিয়ে বেশ সঙ্কটে গিলানি।
পাকিস্তানের এই ঘোরালো পরিস্থিতি চিন্তায় রেখেছে দিল্লিকেও। বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণ যদিও বলেছেন, “এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়।” বিদেশ মন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে, পাকিস্তানের ক্ষমতার শীর্ষে যে-ই থাক, গণতান্ত্রিক সরকার বা সামরিক শাসক, দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলি নিয়ে তার সঙ্গেই কথা বলতে হবেএমনই মনোভাব নয়াদিল্লির। তাই সংশ্লিষ্ট সব মহলের কার্যকলাপের উপরেই নজর রাখা হচ্ছে। তবে একই সঙ্গে বিদেশ মন্ত্রকের কর্তাদের বক্তব্য, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারত সামরিক সরকারের থেকে গণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ফলে চাপে থাকা গিলানির পাশে না দাঁড়ালেও পড়শি দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের কোনও সম্ভাবনাকে প্রশ্রয় দেবে না ভারত।
সকালে নিজেই গাড়ি চালিয়ে সরকারি বাসভবন থেকে শীর্ষ আদালতে যান গিলানি। সঙ্গে ছিলেন রাজনৈতিক সঙ্গী তথা আইনজীবী এতজাজ আসান। আদালতকে সাহায্য করছিলেন পাক অ্যাটর্নি জেনারেল মৌলবি আনওয়ার উল হক। চার্জশিট পড়ে শোনানোর পর বিচারপতিদের বেঞ্চ গিলানিকে প্রশ্ন করে, “আপনি এই চার্জশিট পড়েছেন? দোষ স্বীকার করছেন?” গিলানি সাফ উত্তর দেন, “পড়েছি। দোষী নই। আমি লিখিত ভাবে চার্জশিটের জবাব দেব।” এর পরেই বিচারপতিরা অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দেন, এই মামলায় তিনি বাদী পক্ষের কৌঁসুলি হয়ে কাজ করবেন। আগামী ১৬ তারিখের মধ্যে আদালত অবমাননার মামলা সংক্রান্ত সব তথ্য এবং সাক্ষীদের তালিকাও তাঁকে জমা দিতে বলা হয়েছে। মামলার পরবর্তী শুনানি ধার্য হয়েছে ২২ ফেব্রুয়ারি। তবে গিলানির আইনজীবীকে ২৭ তারিখের মধ্যে সমস্ত নথি ও সাক্ষীর তালিকা সুপ্রিম কোর্টে
জমা দিতে বলা হয়েছে। তার পরেই ২৮ তারিখ গিলানির বিচারের দিন স্থির করবেন বিচারপতিরা। গিলানিকে অবশ্য সেই বিচারপর্বে উপস্থিত হওয়া থেকে ছাড় দিয়েছেন বিচারপতিরা।
এ দিকে পাকিস্তানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্তই। আদালতের রায় শোনার পরেই প্রধানমন্ত্রী গিলানির বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান মুসলিম লিগের প্রধান নওয়াজ শরিফ। তাঁর কথায়, “জারদারি আর গিলানি তো গণতন্ত্রের নামে তামাশা করছেন। সুইস ব্যাঙ্কে পাকিস্তানের নাগরিকদের প্রায় ৬ কোটি ডলার পড়ে রয়েছে। একটা চিঠিতে যদি সেই টাকা দেশে ফেরত আসে, তবে তাতে তাঁর আপত্তিটা কোথায়? সরকার এত ভয় পাচ্ছে কেন?” একই প্রতিক্রিয়া তেহরিক-ই-ইনসাফ প্রধান ইমরান খানের। বলেছেন, “গিলানির এখনই পদত্যাগ করা উচিত। গিলানি ও জারদারি দু’জনেই দুর্নীতিগ্রস্ত।” পাকিস্তান পিপলস পার্টি যদিও এখনও গিলানিতেই আস্থা রেখেছে।
পারভেজ মুশারফ নিজের শাসনকালে ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন অর্ডিন্যান্স’ নামে একটি বিশেষ অর্ডিন্যান্স জারি করেছিলেন। তা অনুযায়ী, ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবরের মধ্যে দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মামলায় অভিযুক্ত তামাম রাজনৈতিক নেতা ও আমলাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। সেই অর্ডিন্যান্সের জোরেই দুর্নীতির মামলাগুলি থেকে রেহাই পান জারদারি। কিন্তু ২০০৯-এর ডিসেম্বরে সেই অর্ডিন্যান্সকে অসাংবিধানিক বলে খারিজ করে দেয় পাক সুপ্রিম কোর্ট। তার পর থেকেই প্রেসিডেন্ট জারদারির বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলা ফের শুরু করতে বলা হচ্ছিল পাকিস্তান সরকারকে। তার জেরেই শুরু হয় গিলানি-আদালত সংঘাত।
|
সংঘাত-কথা |
১৬ ডিসেম্বর, ২০০৯ |
প্রেসিডেন্ট জারদারির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা শুরুর নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের। |
১০ অক্টোবর, ২০১১ |
প্রকাশ্যে আসে মেমোগেট। সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় আমেরিকাকে গোপন মেমো জারদারির। |
২৩ নভেম্বর, ২০১১ |
মেমোগেট-তদন্তের জন্য সুপ্রিম কোর্টে নওয়াজ শরিফের আবেদন। |
৩০ ডিসেম্বর, ২০১১ |
সরকারের আপত্তি টিকল না। মেমোগেট তদন্ত হবে, জানাল সুপ্রিম কোর্ট। |
১৬ জানুয়ারি, ২০১২ |
জারদারির বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা কেন করেননি, গিলানিকে আদালত অবমাননার নোটিস সুপ্রিম কোর্টের। |
৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১২ |
আদালত অবমাননার চার্জ গঠনের সিদ্ধান্ত খারিজের আবেদন গিলানির। |
১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১২ |
গিলানির আবেদন খারিজ। |
১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১২ |
আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত গিলানি। |
|