ট্রাকের ধাক্কায় এক মহিলা খেতমজুরের মৃত্যুতে রবিবার অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে আরামবাগের বেহালা গ্রাম। মৃতদেহ আটকে তৎক্ষণাৎ ক্ষতিপূরণের দাবি তুলে অবরোধ শুরু করে জনতা। অবরোধ তুলতে গেলে তিন ঘণ্টা জনতার সঙ্গে পুলিশের খণ্ডযুদ্ধ চলে। পুলিশের দু’টি গাড়ি, একটি বাস ও ট্রাকে ভাঙচুর করা হয়। জখম হন ৯ পুলিশকর্মী। তাঁদের মধ্যে দু’জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশ শূন্যে গুলি চালায়। বিশাল পুলিশ বাহিনী ও র্যাফ গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়।
হুগলির পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী বলেন, “মারমুখী জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ প্রথমে লাঠি চালায়। তাতেও জনতা দমেনি। ৯ পুলিশকর্মী জখম হন। বাধ্য হয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ শূন্যে চার রাউন্ড গুলি চালায় ও কাঁদানে গ্যাসের গোলা ফাটায়। দুই পুলিশকর্মীকে কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।”
দুর্ঘটনায় মৃত মুনি শবর (৪২) বাঁকুড়ার রানিবাঁধ থানার ঘাগড়া গ্রামের বাসিন্দা। সেখানকারই আরও ৯ জন মহিলার সঙ্গে মুনিদেবী বেহালা গ্রামে ধান রোপণের কাজ করতে আসেন দিন কয়েক আগে। এ দিন একটি মোটরভ্যানে করে তাঁরা কাজে যাচ্ছিলেন। সকাল ৮টা নাগাদ বেহালা গ্রামে ঢোকার মুখে আরামবাগ-বর্ধমান রোডের (মুথাডাঙা হয়ে) ধারে দাঁড়িয়েছিল ভ্যানটি। সেই সময়ে উল্টো দিক থেকে আসা বাসকে পাশ কাটাতে গিয়ে একটি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা মারলে ভ্যানটি উল্টে যায়। ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় মুনিদেবীর। আহত তিন মহিলাকে আরামবাগ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
এর পরেই উত্তেজনা ছড়ায়। জনতা ট্রাকটিতে ভাঙচুর চালিয়ে অবরোধ শুরু করে। অবরোধে সামিল হন এলাকার কয়েক জন তৃণমূল নেতাও। ট্রাক-মালিককে তখনই এসে মৃতের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বলে দাবি ওঠে। দুর্ঘটনার কিছু ক্ষণের মধ্যে স্থানীয় মলয়পুর ফাঁড়ির পুলিশ চলে আসে। কিছু পরে আসে আরামবাগ থানার পুলিশও। পুলিশ অবরোধে আটকে পড়া একটি বাসকে পার করিয়ে দিতে গেলেই ঝামেলা বাধে। পুলিশ দেরিতে এসেছে এবং ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে আলোচনা করেনি, এই অভিযোগ তুলে অবরোধকারীরা বাসটিতে ভাঙচুর চালান। |
পুলিশ লাঠি চালিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করলে তারা আরও মারমুখী হয়ে ওঠে। পুলিশকে লক্ষ করে বোল্ডার, ইট, পাথর ছুড়তে শুরু করে। পুলিশের দু’টি গাড়ির কাচ ভাঙচুর করা হয়। কয়েকশো মানুষের হামলার সামনে গুটিকয়েক পুলিশকর্মী তখন কার্যত অসহায়। কিছু পুলিশকর্মী ভাঙচুর হওয়া বাসটিতে আত্মগোপন করার চেষ্টা করেন। জনতা বাসের দিকেও ইট, বোল্ডার ছোড়ে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, সেই সময়ে বাসের ভিতর থেকে পুলিশ শূন্যে ৮ রাউন্ড গুলি চালায়। এতে খেপে গিয়ে বাসটি ঘিরে ফেলে ট্যাঙ্ক থেকে
পেট্রোল বের করে জ্বালিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করে জনতা। বাস থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করলে ইট-বোল্ডারের ঘায়ে ৯ জন পুলিশকর্মী জখম হন।
এএসআই অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়কে করজোড়ে উন্মত্ত জনতার কাছে সহকর্মীদের প্রাণভিক্ষা করতে দেখা যায়। তাঁর দিকেও উড়ে আসে বোল্ডারের টুকরো। এই গণ্ডগোলের সময়ে অবরোধে সামিল তৃণমূল নেতাদের আর দেখা যায়নি।
মাথায় ইটের বাড়ি খেয়ে গুরুতর আহত হন আরামবাগ থানার সাব-ইন্সপেক্টর তাপস ঘোষ। বুকে বোল্ডার পড়ে কনস্টেবল ধনঞ্জয় খাঁয়ের। দু’জনকেই কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। বাকি সাত আহত পুলিশকর্মীকে আরামবাগ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কনস্টেবল গৌতম বিশ্বাস ভর্তি থাকলেও বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। হামলা থেকে রেহাই পাননি পুলিশের দু’টি গাড়ির চালকও। তাঁদের কিল-চড়-ঘুষি মারা হয়।
দুপুর ১২টা নাগাদ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) অশেষ বিশ্বাসের নেতৃত্বে বিশাল পুলিশ বাহিনী ও র্যাফ গিয়ে ঘটনাস্থলের দখল নেয়। কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটিয়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করা হয়। পুলিশের ঘটনাস্থলে দেরিতে পৌঁছছে, এমন অভিযোগ মানতে চাননি জেলার পুলিশ সুপার।
গোলমালের পরেই ঘটনাস্থল সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামে তল্লাশি চালিয়ে হামলায় জড়িত অভিযোগে ৮ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রামবাসীদের দাবি, পুলিশ নিরীহদের ধরেছে। গ্রামবাসীদের একাংশের অভিযোগ, গোলমালের পিছনে ইন্ধন ছিল স্থানীয় কিছু তৃণমূল নেতার। আরামবাগের তৃণমূল বিধায়ক কৃষ্ণচন্দ্র সাঁতরা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ঘটনাস্থলে আসেন। ওই অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যাদের ইন্ধনেই পুলিশের উপরে হামলা হোক, যথাযথ তদন্ত করে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। প্রশাসনকে আমরা সহযোগিতা করব। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করা হবে না।” |