কর্নাটকের তিন মন্ত্রীকে লইয়া ঢিঢি পড়িয়া গিয়াছে। বি জে পি সঙ্কুচিত। তিন মন্ত্রী পদত্যাগ করিবার পরেও নেতারা তাঁহাদের তীব্র তিরস্কার করিয়াছেন। অণ্ণা হজারেও কংগ্রেস হইতে ক্ষণকালের জন্য দৃষ্টি সরাইয়া এই তিন মন্ত্রীর কারাদণ্ড দাবি করিয়াছেন। এই তিন জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁহারা বিধানসভার অধিবেশন চলাকালীন সভাকক্ষে বসিয়া মোবাইল ফোনে পর্নোগ্রাফি দেখিতেছিলেন। তাঁহাদের উদ্দেশে যে তিরস্কার ধাবিত হইতেছে, সকলই পর্নোগ্রাফি দেখিবার কারণে। জাতীয় প্রশ্ন, নেতা হইয়া এমন ‘অনৈতিক’ কাজ তাঁহারা কী ভাবে করিলেন? দুর্ভাগ্য, এই তিন মন্ত্রীর আচরণের অনৈতিকতা কোথায়, তাহা বুঝিতে অনেকেই ব্যর্থ। পর্নোগ্রাফি দেখা বা না দেখা ব্যক্তিবিশেষের ব্যক্তিগত পছন্দের, অভিরুচির বিষয়। তাহার সহিত নৈতিকতার প্রশ্নটি জুড়িবার কারণ নাই। বিধানসভায় বসিয়া পর্নোগ্রাফি দেখা অনৈতিক। পর্নোগ্রাফির কারণে নহে, বিধানসভার কারণে। বিধানসভায় বসিয়া কী করা চলে, আর কী চলে না, তাহার স্পষ্ট ভেদ আছে। পর্নোগ্রাফি দেখিবার কাজটি সেই ভেদরেখামতে অনৈতিক। ঠিক যেমন বিধানসভায় তাণ্ডব করা, মাইক্রোফোন ভাঙা, সভার অধিবেশনে বিঘ্ন সৃষ্টি করাও অনৈতিক। আজ যাঁহারা কর্নাটকের এই তিন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হইয়াছেন, সভায় তাণ্ডবের ঘটনায় তাঁহাদের সিংহভাগই প্রতিবাদ করেন নাই, নিন্দা করেন নাই। কারণ, নৈতিকতার বোধটি প্রায়শই অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত, বিকৃত। বিধানসভার পরিসরে কোন কাজটি করা চলে আর কোনটি চলে না, অনেকেরই তাহা যথেষ্ট মনে থাকে না। বস্তুত, এই ঘটনার বিষয়ে আলোচনার দাবিতে বিরোধীরা কর্নাটক বিধানসভাকে অচল করিয়া দিয়াছেন। বিধানসভা অচল করিয়া দেওয়াও কিন্তু নৈতিক আচরণ নয়।
রোগটি রাজনীতিকদের নিজস্ব নহে। কোন কাজ কোথায় করা চলে না, এই বোধটি ভারতীয় সমাজেই বিরল। সমাজের প্রতিটি জনপরিসরেরই কিছু আচরণবিধি থাকে। কিছু ক্ষেত্রে সেই বিধি লিখিত, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অলিখিত। কিন্তু, বিধি লিখিত হউক বা অলিখিত, সভ্য সমাজে তাহা মান্য করিতে হয়। ভারতীয় সমাজে নিয়ম ভাঙিবার প্রবণতা অতি তীব্র। আচরণবিধির ক্ষেত্রে তো বটেই। নিয়ম ভাঙিতে ভাঙিতে এক সময় সেই নিয়মের অস্তিত্বের কথা ভুলিয়া যাওয়াই দস্তুর। ভারতীয় সমাজও জনপরিসরের আচরণবিধির কথা ভুলিয়া গিয়াছে। সমস্যাটির দুইটি মাত্রা। এক, অধিকাংশ মানুষই বোধ করেন, তিনি কোনও অন্যায় করিতে পারেন না; দুই, যে বিধি সকলেই ভাঙে, তাহা ভাঙিবার মধ্যে যে অন্যায় আছে, এই কথাটি বিস্মৃত হওয়া অতি সহজ। ফলে, প্রকাশ্য স্থানে জঞ্জালের স্তূপ বানাইয়া রাখা হইতে যত্রতত্র হাত দেখাইয়া বাসে চড়িতে চাওয়া বহুজনের বহু দৈনন্দিন আচরণই সামাজিক বিধির পরিপন্থী। এবং, এই নিত্য অন্যায় সম্বন্ধে সচেতনতার অভাব ভয়ঙ্কর। এই সমাজেই শিশুরা বড় হইয়া ওঠে, এই সমাজেই কিশোররা এক সময় ভোটাধিকারসম্পন্ন নাগরিকে পরিণত হয়। মানুষের বয়স বাড়ে, বোধ বাড়ে না। সেই বোধের অভাবই সর্বত্র প্রতিফলিত হয়। কর্নাটকের তিন মন্ত্রী এক ভাবে এই বোধের অভাবের পরিচয় দিয়াছেন। দেশের অন্যান্য আইনসভায় আরও অনেকে অন্য ভাবে বোধহীনতার পরিচয় দেন। সকলই সমান নিন্দনীয়। কর্নাটকের এই তিন মন্ত্রী পর্নোগ্রাফি দেখিয়াছেন বলিয়া তাঁহাদের একঘরে করিবার সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মধ্যে যে অন্য অনেক অনৈতিক আচরণের অনৈতিকতাকে গোপন করিবার চেষ্টা আছে, সে বিষয়ে সচেতন থাকা ভাল। |