বস্তুটি দৃশ্যত নিরাকার, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বিরাজমান। সাধারণ্যে তাহার নাম ‘সিন্ডিকেট’। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় তাহার প্রতাপ বিপুল, কিন্তু নির্মীয়মাণ ‘নিউ টাউন-রাজারহাট’ উপনগরী অঞ্চলে বিগত কিছু কাল ধরিয়াই ইহার আস্ফালন প্রবল বাড়িয়াছে। সেই সূত্রেই আপাত-অদৃশ্য ‘সিন্ডিকেট’-এর চর্চা। চর্চা হইতে দুইটি বিষয় উঠিয়া আসিতেছে। এক, প্রশাসনের ক্রমিক নিষ্ক্রিয়তা। দুই, এই বিতর্কিত ‘সিন্ডিকেট’-এর সহিত রাজ্যের মুখ্য শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের একাধিক নেতা এবং মন্ত্রীর জড়িত থাকিবার অভিযোগ। সমাধানটি কঠিন নহে, সত্য, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাহার প্রয়োগ ক্রমেই কঠিনতর হইতেছে। সমাধানটি সংক্ষিপ্ত। ‘সিন্ডিকেট’ বলিয়া যদি কোনও আইন-বহির্ভূত অস্তিত্ব অন্যায় চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করে, তাহা হইলে যথাবিহিত আইনি পথেই তাহার মোকাবিলা করিতে হইবে। যে কোনও নির্মাণের উপকরণ, সরঞ্জাম ইত্যাদির জন্য খোলা বাজার রহিয়াছে। সেই বাজার হইতে যে কেহ ইচ্ছামত প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করিতে পারেন। ‘সিন্ডিকেট’ যদি দাবি করে, তাহার নাগাল এড়াইয়া কোনও নির্মাণের উপকরণ কেনা চলিবে না, কিনিলে নানা ভাবে সেই ব্যক্তি বা সংস্থাকে হয়রান করা হইবে, তখন সেই অন্যায় আবদারকে কঠোর ভাবে রুখিতে হইবে। যে ভাবে পুলিশ ও প্রশাসন অন্য পাঁচটি অপরাধের মোকাবিলা করে, এই ক্ষেত্রেও তাহার ব্যত্যয় ঘটিবার কোনও কারণ নাই।
অথচ, ব্যত্যয় ঘটিতেছে। সরকারি সংস্থা ‘হিডকো’র আয়োজনে ‘সিন্ডিকেট’-এর কিছু লোকের সহিত বৈঠকের বন্দোবস্ত হইয়াছে। কেন হইয়াছে, সেই ব্যাপারে ‘হিডকো’-র ব্যাখ্যা ‘সিন্ডিকেট’ লইয়া অভিযোগের মাত্রা যে হেতু ক্রমবর্ধমান, সুতরাং একটি কার্যকর সমাধান খুঁজিবার জন্যই বৈঠক। অভিযোগের কথাটি সত্য। কিন্তু, ইহা এমনই একটি অভিযোগ যাহা আইনশৃঙ্খলার সহিত জড়িত। ইহা উপনগরী-নির্মাণজনিত কোনও গুরুত্বপূর্ণ নীতি-নির্ধারণের বিষয় নহে যে, বৈঠক ডাকিয়া ‘হিডকো’ একটি উত্তর খুঁজিবার প্রয়াস করিবে। বেআইনি চাপ সৃষ্টির অভিযোগ প্রমাণিত হইলে যাহাদের শ্রীঘরে থাকিবার কথা, তাহাদের সাদরে বৈঠকের কক্ষে ডাকিবার কারণ কী, সেই প্রশ্নটি থাকিয়াই যায়। ইহাতে কাজের কাজ কত দূর হয় বা হইয়াছে, সেই প্রশ্ন অন্য। সমস্যা হইল, ইহার ফলে সম্পূর্ণ বেআইনি এবং অপরাধমূলক একটি সাংগঠনিক অস্তিত্ব এক ধরনের পরোক্ষ আইনি বৈধতা লাভ করিতে পারে। বহির্বিশ্বে যদি এমন কোনও বার্তা যায় যে, ‘হিডকো’ বৈঠকে ডাকিয়া এই ধরনের সংগঠনকে এক ধরনের মান্যতা প্রদান করিতেছে, সেই ব্যাখ্যাকে উড়াইয়া দেওয়া চলিবে না। অর্থাৎ, ‘সিন্ডিকেট’-এর ব্যাপারে প্রশাসনিক নীতি কী ভাবে নির্ধারিত হইবে, হিডকো-র এই বৈঠক সেই বিষয়ে একটি প্রভাব ফেলিতে পারে।
সুশাসন দাবি করে, ‘সিন্ডিকেট’-এর সমস্ত অবৈধ কাজকর্ম কড়া ভাবে দমন করা জরুরি। রাজধর্ম বলে, সেই প্রশাসনিক পদক্ষেপের সময় দলনির্বিশেষে ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে হইবে। সেই কাজটি যথাযথ হইতেছে কি? প্রশ্নটি উঠিতেছে, এবং বিভিন্ন সূত্রে যে নামগুলি উঠিয়া আসিতেছে, তাহা নিঃসন্দেহে প্রশাসনিক অস্বস্তির কারণ। প্রশাসনিক এবং দলীয়, বিভিন্ন মহল হইতে ক্রমাগত বলা হইতেছে যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিষয়ে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করিবার নির্দেশ দিয়াছেন। প্রশ্ন হইল, সেই সদিচ্ছাটির বাস্তব রূপায়ণ কত দূর হইতেছে! সুশাসন যে চলিতেছে, প্রশাসন যে অপরাধ দমনে সক্রিয়, তাহা জনসমক্ষে দৃশ্যমান হওয়াও জরুরি। কালহরণ অনেক হইয়াছে। সুশাসনটি দৃশ্যমান হইবে কি? |