শহরের কোনও নির্জন গা-ছমছমে গলি নয়। ছুটির সকালে বড়বাজারের জমজমাট কচুরির দোকানের সামনের রাস্তা। প্রাতরাশ সেরে হেলতে-দুলতে বেরিয়ে তখন সবে গাড়িতে উঠছেন তরুণ দম্পতি। তাঁদের হঠাৎ ঘিরে ধরে হাতে ছুরি মেরে আংটি-গলার চেন কেড়ে নিচ্ছে দু’জন দুষ্কৃতী। পথচারীরা হতভম্ব। রবিবার সকাল ন’টায় এমনটাই দেখল কলকাতা।
এর ঠিক ১২ ঘণ্টা আগেই রাতের বড়বাজারের ছবিটাও খুব আলাদা নয়। ব্যবসার টাকা আদায় করে ব্যাগ বগলে ফেরার পথে কলাকার স্ট্রিটের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় আততায়ীর গুলি এক ব্যক্তির পাঁজর ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল। টাকার ব্যাগ সমেত দুষ্কৃতী হাঁটতে হাঁটতে পগারপার।
দু’দিন আগেই কসবা রথতলায় কয়েক মুহূর্তের জন্য একটি বাড়ির দরজা খোলা পেয়ে ভিতরে ঢুকে ছ’মাসের শিশুর মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে তার দিদিমা ও আয়াকে যা আছে সব বার করে দিতে বলে দুই দুষ্কৃতী। কিংবা কসবায় বিকেলের পার্কে ছিনতাইকারীকে ঠেকাতে গিয়ে দুই সন্তানের সামনেই গুলিবিদ্ধ হন এক মহিলা।
শহরের পরিচিত এলাকায় অনেক লোকের চোখের সামনে এ ভাবেই পরপর ঘটে চলেছে দুঃসাহসী লুঠ থেকে খুনোখুনির ঘটনা। দিনেদুপুরে ভরা বাজারের সামনেও ঘটছে ছিনতাই। ইদানীংকালের এমন বেশির ভাগ ঘটনারই কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। রথতলার ঘটনায় অবশ্য এক জন গ্রেফতার হয়েছে। তবে কার্যত খেয়াল-খুশি মতো শহরের যত্রতত্র এই ‘দুষ্কৃতী-রাজ’-এর বাড়বাড়ন্তে রক্তচাপ বাড়ছে লালবাজারের কর্তাদের।
|
বেপরোয়া দুষ্কৃতীরাজ |
২৪ জানুয়ারি |
কসবায় গুলিবিদ্ধ বিদ্যা
দেশাই নামে এক মহিলা। |
২৪ জানুয়ারি |
পার্ক সার্কাস প্ল্যাটফর্মে ব্যাগে
বালিকার দেহ।
ছিল জামাকাপড়ও। |
২৫ জানুয়ারি |
ঢাকুরিয়া ব্রিজের তলায় একই রকম
ব্যাগে কিশোরীর দেহ। সঙ্গে স্কুলের পোশাক। |
২৮ জানুয়ারি |
বাগুইআটির একটি বাড়িতে
মা-মেয়ের রক্তাক্ত দেহ। |
৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি |
কল্যাণী ও শিয়ালদহ স্টেশনে চারটি
বস্তায়
এক যুবকের চার টুকরো দেহাংশ। |
১০ ফেব্রুয়ারি |
কসবায় শিশুর
মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে লুঠ। |
১১ ফেব্রুয়ারি |
কলাকার স্ট্রিটে
গুলি করে ব্যবসায়ী খুন। |
১২ ফেব্রুয়ারি |
ছুরি মেরে গলার
চেন ও আংটি ছিনতাই। |
|
রবিবার সকালেই কসবা তথা দক্ষিণ শহরতলিতে আইন-শৃঙ্খলার হাল নিয়ে কলকাতা পুলিশের সংযুক্ত এলাকার ওসিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন পুলিশ কমিশনার রঞ্জিতকুমার পচনন্দা। এর মধ্যেই শহরের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা বড়বাজারের দু-দু’টি ঘটনা। পুলিশ জানায়, হরিরাম গোয়েন্কা স্ট্রিটে কচুরির দোকানের সামনে যে দম্পতির উপরে হামলা হয়েছে, তাঁরা হলেন অমিত রুংটা ও জ্যোতি। ছুরির কোপে অমিত জখম হন। জ্যোতির কথায়, “এত লোকের সামনে এমন ঘটতে পারে, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।”
শহরে হঠাৎ কেন বাড়ছে এমন দুঃসাহসী লুঠের ঘটনা? কেনই বা দুষ্কৃতীদের ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে পুলিশ? লালবাজারের গোয়েন্দা-অফিসারদের ব্যাখ্যা, “ইদানীং ছোটখাটো পকেটমার-ছিনতাইবাজরাও হিংসাত্মক হয়ে উঠছে। মরিয়া হয়ে যেনতেন প্রকারে কাজ হাসিল করতে চাইছে তারা।” তাঁদের মতে, “এর একটাই দাওয়াই, তদন্ত করে ধরপাকড় এবং আদালতে কড়া সাজা।” গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেনের অবশ্য আশা, “শীঘ্রই সব অপরাধের কিনারা হবে। কয়েক জনকে আটক করা হয়েছে।”
কিন্তু সন্দেহভাজনদের আটক করা তো পরের কাজ, জনবহুল এলাকায় এই ধরনের ঘটনা ঠেকানো যাচ্ছে না কেন? পুলিশকর্তাদের কাছে এর সদুত্তর মেলেনি। এর জেরে আম-নাগরিকের পুলিশের প্রতি ‘আস্থা’য় চিড় ধরছে। এ দিন সকালের ঘটনায় বড়বাজারের স্থানীয় বাসিন্দা তথা ব্যবসায়ী লক্ষ্মীনারায়ণ অগ্রবালের অভিযোগ, “রাস্তায় ভিড়ের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটে গেল, পুলিশ কিচ্ছু করতে পারল না। টাকাকড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোতেই ভয় করছে।” পুলিশ অবশ্য বড়বাজার এলাকায় অফিসগুলিতে ক্লোজড সার্কিট টিভি বসাতে ব্যবসায়ীদের ‘অনীহা’কেও দুষছে। সেই সঙ্গে তারা মানছে, ইদানীং লোকাভাবে রাজপথের কিয়স্কগুলিও অনেক সময়ে বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
আট-ন’বছর আগে ভিন্ রাজ্যের গ্যাং-এর হাতে বড়বাজার-পোস্তায় পরপর লুঠে ব্যতিব্যস্ত হয়ে টাস্কফোর্স গড়েছিল পুলিশ। কিন্তু এ যাত্রা ঘটনাগুলি পূর্বপরিকল্পিত নয় বলে পুলিশের ধারণা। এর পিছনে সংগঠিত চক্রেরও হাত নেই। ফলে, পুলিশ কমিশনার বৈঠক ডেকে বারবার অপরাধ-দমনের কথা বললেও তা কী ভাবে কার্যকর হবে, তার রাস্তা খুঁজতে কার্যত অন্ধকারে হাতড়াচ্ছে পুলিশ। |