সঞ্চয় এবং লগ্নির প্রথম শর্ত হল একটি সেভিংস ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। এখানে টাকা জমা পড়লে বেশির ভাগ মানুষই চান না পুরোটা তুলে নিতে। অর্থাৎ কিছু টাকা এই ভাবে জমেই যায়। অন্য দিকে কোনও আয় নগদে নিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তার পুরোটাই খরচ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে একবার টাকা জমতে শুরু করলে জমানোটা মানুষের অভ্যাসে পরিণত হয়। সঞ্চয় বেড়ে উঠছে দেখতে সকলেরই ভাল লাগে। সবাই চান, পরের ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট বা পাশ বুকে জমার অঙ্কটা বেড়ে উঠুক। এতে মানসিক প্রশান্তি হয়। আর্থিক সুরক্ষার দিকটা তিল তিল করে মজবুত হয়।
অথচ শুনে অবাক হতে হয়, বড় বড় শহরে এখনও অনেক শিক্ষিত মানুষ আছেন, যাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই নেই। এমন অনেক সংস্থা এবং দফতর আছে, যেখানে এখনও স্থায়ী কর্মীদের বেতনও নগদে দেওয়া হয়। ফলে এঁদের নিয়ম মতো সঞ্চয় হয় না। স্বনিযুক্ত এমন অনেক ছোট ব্যবসায়ী এবং পেশাদার আছেন, যাঁরা পুরো নগদে কারবার করেন, এবং ব্যাঙ্কে টাকা গচ্ছিত করেন না। ছোট চাষিদের বেশির ভাগই নগদে ফসল বিক্রি করেন এবং বিক্রির টাকা নানা ভাবে খরচ হয়েই যায়। পরে বীজ ও সার কেনার টাকা মেলে না। ফলে ঋণ করা ছাড়া উপায় থাকে না।
অর্থাৎ একটি সেভিংস ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট প্রয়োজন প্রত্যেকের। এর সুবিধা অনেক। সংক্ষেপে এই রকম:
১) টাকা সুরক্ষিত থাকে। হারানো বা চুরি হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে না।
২) সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে মোটা টাকা জমে উঠতে থাকে সেভিংস অ্যাকাউন্টে। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির মোট আমানতের একটি বড় অংশই গচ্ছিত আছে এই সব ব্যক্তিগত সেভিংস অ্যাকাউন্টে।
৩) জমার উপর এখন আকর্ষণীয় হারে সুদ পাওয়া যায়। সেভিংস অ্যাকাউন্টের সুদের উপর রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি এখন সুদ দিচ্ছে ৪ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত হারে।
৪) সুদ এখন কষা হয় দৈনিক ব্যালান্সের ভিত্তিতে, আগের মতো ন্যূনতম ব্যালান্সের ভিত্তিতে নয়।
৫) যুগ্ম নামে অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। নমিনেশনের সুবিধা আছে।
৬) রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে ছোট শহর এবং গ্রামাঞ্চলে ৫০০ টাকা এবং বড় শহরে ১০০০ টাকা জমা করে অ্যাকাউন্ট খোলা যায়। চেকের সুবিধা নিতে হলে কমপক্ষে ১০০০ টাকা জমা রাখতে হয়। বেতন অ্যাকাউন্ট এবং ছাত্রছাত্রীদের অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে এই শর্ত শিথিল করা হয়। বেসরকারি এবং বিদেশি ব্যাঙ্কে ন্যূনতম জমার পরিমাণ সাধারণত বেশি হয়।
৭) অ্যাকাউন্ট খোলার সময় গ্রাহককে দেওয়া হয় একটি এটিএম/ডেবিট কার্ড। এই কার্ড ব্যবহার করে যে-কোনও সময়ে নিজের ব্যাঙ্ক অথবা অন্য ব্যাঙ্কের এটিএম মারফত টাকা তোলা যায়। অন্য ব্যাঙ্কের এটিএম থেকে মাসে পাঁচ বার বিনা মাসুলে টাকা তোলা যায়। অন্য শহরে চিকিৎসা অথবা ভ্রমণের ক্ষেত্রে এই কার্ড অত্যন্ত উপযোগী। সব সময়ে অযথা নগদ টাকা নিয়ে যাতায়াত করতে হয় না। এটিএমে নগদ ও চেক জমা দেওয়াও চলে। ছোট স্টেটমেন্ট পাওয়া যায়। ব্যালান্স জানা যায়।
৮) প্রত্যেকটি অ্যাকাউন্টের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি সাধারণত একটি পাসবুক দেয়। অন্যরা ইস্যু করে ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট। সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এই মর্মে একটি বিজ্ঞপ্তি ইস্যু করেছে যে, কোনও গ্রাহক আবেদন করলে
বিনা মাসুলে সেভিংস ব্যাঙ্ক
পাসবুক ইস্যু করতে বাধ্য থাকবে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি।
৯) সেভিংস ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে একই ব্যাঙ্কের অন্য শাখায় অথবা অন্য কোনও ব্যাঙ্কেও অতি সহজেই টাকা স্থানান্তরিত করা যায়। মেটানো যায় বিদ্যুৎ বিল, টেলিফোন বিল-সহ নানা ধরনের বিল।
১০) বেশির ভাগ ব্যাঙ্কেই এখন চালু হয়েছে ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিং এবং মোবাইল ব্যাঙ্কিংয়ের সুবিধা। কিন্তু এই সব সুবিধা
নিতে হলে একটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকা আবশ্যক।
১১) শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, বন্ড ইত্যাদিতে লগ্নি করতে হলে সেভিংস অ্যাকাউন্ট থাকা বাধ্যতামূলক। লগ্নির উপর প্রাপ্য সুদ ও ডিভিডেন্ড জমা হয় সেভিংস অ্যাকাউন্টে।
১২) আয়কর রিটার্নে দাখিল করতে হয় নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর। উপযুক্ত ক্ষেত্রে ফেরত পাওয়া কর জমা করতে হয় এই অ্যাকাউন্টেই।
১৩) আয়কর আইন অনুযায়ী বিভিন্ন সংস্থাকে ২০,০০০ টাকার বেশি অর্থ সব সময়েই প্রদান করতে হয় চেকের মাধ্যমে। এই চেক ভাঙানোর জন্য অবশ্য প্রয়োজন একটি সেভিংস ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের। ডাকঘরগুলিও এখন লগ্নি ফেরত দিচ্ছে চেকের মাধ্যমে।
১৪) ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের পাসবুকে উল্লিখিত ঠিকানা অনেক সময়েই নথিপত্র দাখিল করার ক্ষেত্রে ঠিকানার প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করা হয়।
১৫) কোনও ব্যাঙ্কে লকারের সুবিধা নিতে হলে সেই ব্যাঙ্কে একটি সেভিংস অ্যাকাউন্ট থাকা প্রয়োজন। একই ভাবে মেয়াদি জমার সুদ নিয়মিত পেতে হলে একটি সেভিংস ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে।
১৬) ডাকঘরেও খোলা যায় সেভিংস অ্যাকাউন্ট। এখানে একক নামে খোলা অ্যাকাউন্টে বছরে ৩,৫০০ টাকা এবং যুগ্ম নামে খোলা
অ্যাকাউন্টে ৭,০০০ টাকা পর্যন্ত সুদ থাকে করমুক্ত।
১৭) নিয়মিত পেনশন সংগ্রহ করার জন্যও আপনার থাকতে হবে একটি সেভিংস অ্যাকাউন্ট। বেশির ভাগ সংস্থা এখন কর্মীদের বেতন দেয় ব্যাঙ্কের মাধ্যমেই।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সেভিংস ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট না থেকে উপায় নেই। তা সত্ত্বেও অনেক মানুষেরই এখনও এই অ্যাকাউন্ট নেই। অনেকের মনে ভীতি আছে যে, অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে প্যান কার্ড দেখাতে হবে এবং প্যান কার্ড ব্যাঙ্কে দেখালে ফি-বছর আয়করের রিটার্ন দাখিল করতে হবে। এই ভয় কিন্তু পুরোটাই অমূলক।
সুতরাং সেভিংস অ্যাকাউন্ট সকলেরই খোলা উচিত। চাকুরে, স্বনির্ভর, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি, ছাত্রছাত্রী, গৃহী মহিলা, ছোট ব্যবসায়ী, চাষি, মজুর, রোজগেরে গিন্নি সবারই প্রয়োজন এই অ্যাকাউন্ট। |