রাজ্য সরকারের সুতোকলগুলির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা থেকে ধারে তুলো কিনেছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। এখন সেই ধার শোধ করতে হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে।
‘দি কটন কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড’ (সিসিআই) নামে কেন্দ্রীয় সংস্থাটির কাছ থেকে রাজ্য সরকারের মিলগুলি ধারে প্রায় সাড়ে ন’কোটি টাকার তুলো কিনেছিল। এখন রাজ্য ধার শোধ না-করলে চাকরি যাবে ওই কেন্দ্রীয় সংস্থার ছয় পদস্থ আধিকারিকের। ওই আধিকারিকরা সেই সময়ে রাজ্য সরকারি মিলগুলিকে ‘বাঁচাতে’ নির্দিষ্ট সীমার বাইরে গিয়ে ধারে তুলো সরবরাহ করেছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থাটির সূত্রে জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যেই ওই ছয় আধিকারিককে সাসপেন্ড করেছেন কর্তৃপক্ষ। টাকা আদায় করতে না-পারলে ওই আধিকারিকদের বরখাস্ত করা হবে বলে সতর্কও করা হয়েছে। চাকরি বাঁচাতে ওই আধিকারিকদের একাংশ রাজ্যের মন্ত্রী থেকে আমলাদের কাছে আর্জি জানাতে শুরু করেছেন।
তবে তাঁদের এখনই কোনও ‘নিশ্চয়তা’ দিতে পারেননি সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রী-আমলারা। একেই রাজ্যের অর্থভাণ্ডারের বেহাল অবস্থা। তার উপর সরকারের পাঁচটি মিলের মধ্যে তিনটিতেই উৎপাদন বন্ধ। রাজ্যের বস্ত্রমন্ত্রী মানস ভুঁইয়ার কথায়, “বামফ্রন্ট সরকার তার পাপের বোঝা আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে গিয়েছে। আমরা তো কানে তুলো গুঁজে বসে থাকতে পারব না! সরকারি সংস্থার ব্যাপার। সমাধান তো করতে হবে। কিন্তু আমরা সব দিক খতিয়ে দেখে টাকা শোধ করব।”
মিলগুলির ‘দুরবস্থা’ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতাও ‘উদ্বিগ্ন’ জানিয়ে মানসবাবু বলেন, “সমস্যা মেটানোর জন্য অর্থ দফতরের সঙ্গে আলোচনা করছি।’’ সিসিআইয়ের আধিকারিকদের ‘আশঙ্কা’ নিয়ে বস্ত্র দফতরের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব (অ্যাডিশনাল চিফ সেক্রেটারি) অনুপ চন্দ্র বলেন, “ওটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। ওটা সিসিআইয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়।” সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করছেন জানিয়েও অনুপবাবুর বক্তব্য, “রাজ্য সরকারি মিলগুলির জন্য চার কোটি টাকা পর্যন্ত ধারে তুলো দেওয়ার কথা ছিল সিসিআইয়ের। তা হলে অতিরিক্ত সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার তুলো কেন ধারে দেওয়া হল? সেটা জানতে হবে!”
রাজ্যের যে তিনটি মিলের কাছে সিসিআই টাকা পায়, তার একটি ‘ওয়েস্ট দিনাজপুর স্পিনিং মিল’। তার চেয়ারম্যান তথা রায়গঞ্জের বিধায়ক মোহিত সেনগুপ্তের অভিযোগ, “আমাদের আগে মিলে সিপিএমের নেতৃত্বাধীন কমিটি কেলেঙ্কারি করে গিয়েছে। বাম সরকারের আমলেই তুলো কেনা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের মিলে তো গত এক বছর উৎপাদন বন্ধ! তা হলে কেন ধারে তুলো কেনা হয়েছিল?” ওই মিলের তুলো কেনা বাবদে সুদ-আসলে ধারের পরিমাণ দেড় কোটি টাকার বেশি বলে অনুপবাবুকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন সিসিআইয়ের চেয়ারম্যান তথা ম্যানেজিং ডিরেক্টর বি কে মিশ্র। মূলত ২০০৯-২০১০ আর্থিক বছরেই ধারে তুলো নেওয়া হয়েছিল বলে সরকারি সূত্রের খবর।
ধারে তুলো নেওয়ায় নদিয়ার স্পিনিং মিলের থেকে সিসিআইয়ের বকেয়া পাওনা ৫ কোটি ১৫ লক্ষ ৮৩ হাজার টাকা। ওই মিলের প্রাক্তন চেয়ারম্যান তথা শান্তিপুরের বিধায়ক অজয় দে বলেন, “ওই তুলো কেনা হয়েছিল বাম সরকারের আমলে।” মাস দুই আগে মিলের চেয়ারম্যানের পদে ইস্তফা দেওয়া অজয়বাবুর অভিযোগ, “বাম সরকারের সময়ে কোনও পরিকল্পনা না থাকায় ধারের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে। উৎপাদনের হার কমলেও মিলে আধিপত্য বজায় রাখতে সিপিএম যথেচ্ছ লোক নিয়োগ করেছে। সব মিলিয়ে মিলটি ডুবেছে।” ধার রয়েছে শ্রীরামপুরের ‘ওয়েস্টবেঙ্গল কো-অপারেটিভ স্পিনিং মিল’-এরও। রাজ্য সরকারি ওই মিলকে ধারে তুলো দেওয়ায় সিসিআইয়ের পাওনা হয়েছে ২ কোটি ৬৮ লক্ষ ৯১ হাজার টাকা। মিলের বর্তমান চেয়ারম্যান খালেদ এবাদুল্লা জানিয়েছেন, উৎপাদন বন্ধ। মিলের ৫৪৯ কর্মী গত ৪ মাস ধরে মাইনে পাচ্ছেন না।
উৎপাদন বন্ধ থাকাকালীন ধারে-নেওয়া তুলো কোথায় গেল, তা নিয়ে সিসিআই ইতিমধ্যেই মিলগুলিতে খোঁজ শুরু করেছে। সেই তুলো বিক্রি করে ধারের টাকা আদায় করার জন্য রাজ্য সরকারের দ্বারস্থ হয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্থাটি। কিন্তু ঋণ শোধ করার পরেও মিলগুলি চালু করা যাবে কিনা, তা নিয়ে সরকারি স্তরেও সংশয় আছে। সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে, পাঁচটি মিলের আধুনিকীকরণ করে সেগুলি চালু করার ব্যাপারে সরকার একটি প্রকল্প তৈরির পরিকল্পনা করছে। মিলগুলির ‘উদ্বৃত্ত’ জমি বিক্রি করে অর্থের সংস্থান করা এবং ‘পিপিপি মডেলে’ মিলগুলি চালানোর কথাও ভাবছে সরকার। |