দেশটা কিন্তু একই। তবে ভারত এমনই এক দেশ, যার মধ্যে অনেকগুলো
দেশ এক সঙ্গে থাকে। তেমনই এক ভূখণ্ডের ভিন্ন স্বাদ পেলেন
বিশ্বজিৎ রায় |
ছিমছাম কোচি বিমানবন্দরে বসে বার বার মনে পড়ছিল জিমি পটাশের কথা। জিমি, পটাশ ফার্মের মালিক, কেরলের সম্পন্ন কৃষক। বাড়ি ইডিকু জেলায়, মুনারের পাহাড় সংলগ্ন অঞ্চলে। তাঁর বাড়ির বসার ঘর থেকে দিব্যি দেখা যায় সেই অপরূপ পাহাড়, তার ধাপে ধাপে চা কফি আর নানা মশলাপাতির চাষ হয়। জিমির বাড়িতে হাজির হয়েছিলাম শনিবারের সন্ধেবেলায়। তাঁর বাড়িতে ঢোকার আগে অবধি সম্পন্ন কৃষকের বাড়ি কেমন হতে পারে সে আন্দাজ আমার ছিল না। ছোটবেলায় হেমন্তের গলায় কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা শুনেছিলাম আর চার পাঁচ জন বাঙালির মতোই। সেই গানে যে গ্রামের কথা ছিল তা ঘুঘু-ডাকা, ছায়ায় ঢাকা বাংলার গ্রাম। কিসান আর কিসানির মায়াময় কুটিরে বারো মাসে তেরো পার্বণ হত। পটাশের বাড়ি কুটির নয়। মূল পিচরাস্তা এঁকে-বেঁকে উঠে গেছে মুনারে, পাহাড় শীর্ষে। আর সেই রাস্তার ধারে একটু নেমে গেলেই পটাশ ফার্ম। ব্যাডমিন্টন কোর্টের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলে তাঁর দোমহলা বাড়ি। পটাশের বন্ধু ফাদার জনি-র সঙ্গ নিয়েছিলাম বলে পটাশের বাড়িতে রাত্রি যাপনের সুযোগ মিলল। জনি থাকবেন চার্চে। রবিবার সেখানে তাঁর সার্ভিস দেওয়ার কথা। |
বাইরে না-শীত না-গরম। বসন্ত-পূর্ব কেরল। আমি আর পটাশ মুখোমুখি। জনির কলেজে ইউনিয়ন খ্রিস্টান কলেজে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বলতে এসেছি শুনে পটাশ বলল, ‘রবীন্দ্রনাথ নয়, তোমাদের যাকে আমার ভাল লাগে সে বিদ্যাসাগর। গীতাঞ্জলির কবিতায় কি কাজের কথা আছে? নেই। আর তোমাদের বিদ্যাসাগরের জীবনের একটা ঘটনা শুনেছিলাম। এক জন লোক নিজের সুটকেশ বইতে দ্বিধা করছে, বিদ্যাসাগর এসে নিজে বয়ে দিলেন! আমার খুব ভাল লাগে। নিজের কাজ নিজে করার কথা, শ্রম আর উদ্যোগের কথা। বিদ্যাসাগরের জীবনের মূল।’ কেরলের এই শিক্ষিত কৃষক নিশ্চয়ই বঙ্গ সংস্কৃতি বিশারদ নন, তবে নিজের কাণ্ডজ্ঞান থেকে মতামত দিচ্ছিলেন। শুনছিলাম, মন্তব্য করছিলাম। বললাম, ‘জানো তো, রবীন্দ্রনাথের কৃষি নিয়ে নানা পরিকল্পনা ছিল, নিজের ছেলে রথীন্দ্রনাথকে কৃষিবিদ্যা পড়াতে ইলিনয়ে পাঠিয়েছিলেন, বিজ্ঞানসম্মত ভাবে কেমন করে চাষ করা যায়, ফলন বৃদ্ধি করা যায়, এ সব নিয়ে নানা চিন্তা ছিল তাঁর। তিনি মনে করতেন, ভারতবর্ষে কৃষিকার্যের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
রামের গ্লাসে চুমুক দিয়ে একটু উদাস হয়ে গেল জিমি। বলল, ‘জানো, চাষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল; কিন্তু আর চালিয়ে নিয়ে যেতে পারব না। বাইরের রাস্তাটা দেখছ ওটা মুনার পাহাড়ে চলে গেছে। নব্বই সালের আগে এই রাস্তাটা কী শান্ত ছিল! খুব বেশি গাড়ি যাতায়াত করত না। ক্রমে নব্বইয়ের পর থেকে সব কিছু বড় বদলে গেল, মুনারকে ঘিরে গড়ে উঠল পর্যটন শিল্প এখন শুনি, মুনারের এই পর্যটন শিল্প প্রায় তিন লাখ লোকের রুটি রুজি দিয়েছে। বিদেশিরা আসে, বেঙ্গালুরুতে যারা কাজ করে সেই নানা প্রদেশের ভারতীয়রা এখানে দিন কাটাতে আসে। চাষে যে শারীরিক শ্রম হয় তা আর এখন অনেকে করতে চায় না, লেবার পাওয়া দুষ্কর। তা ছাড়া আমি চাষ করার জন্য এক জন কৃষিমজুরকে কত আর টাকা দিতে পারব! তার বদলে মুনারের রুটে অটো চালালে দিনে পাঁচশো টাকা রোজগার হয়। সুতরাং কৃষিতে মজুরের অভাব দেখা দেবেই। কাজেই ভেবো না চাষ থাকবে। আমি আর আমার ছেলে চালিয়ে নেব, কিন্তু আমাদের পরের জেনারেশন চাষ করবে না। কাজেই তোমাদের রবীন্দ্রনাথ চাষ নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা আশির দশকে সত্যি ছিল, নব্বইয়ের পর থেকে তত সত্যি নেই।’
পটাশের নাতি পাবলিক স্কুলে পড়ে, ইংরেজি, হিন্দি আর মালয়ালম জানে। সে ঠাকুরদাকে এসে বলে গেল রাতের খাবার রেডি। উঠে পড়লাম। খেতে খেতে বাকি কথা। জিগ্যেস করলাম, ‘তোমার হতাশ লাগে না?’ হেসে উঠল পটাশ, বলল, ‘হতাশ লাগবে কেন! দেখ, আমি খুব খোলা মনের মানুষ। ষাটের ওপর আমার বয়স। এখন খোলা চোখে সব ভাবতে ইচ্ছে করে। তুমি নাম্বুদ্রিদের কথা জান? একটা উপকথা শোনো। কেরলে নাম্বুদ্রি বংশের নিয়ম ছিল, পরিবারের বড় ছেলে ছাড়া আর কেউ বিয়ে করতে পারবে না, অন্য পুরুষেরা প্রয়োজনে রমণীসঙ্গ করতে পারে, কিন্তু পরিবার, পুত্র আর সম্পত্তির অধিকার তাদের নেই, জ্যেষ্ঠ ছাড়া অন্য পুত্রদের স্বীকৃতি নেই। তারা ক্রমে অন্য ধর্ম নিল, স্বীকৃতি মিলল। এটাই হয়। আমি আর আমার ছেলে চাষ করে পরিচিতি পেয়েছি, আমার নাতিরা অন্য কিছু করে পরিচিতি লাভ করবে। এই যে চাষে সংকট দেখা যাচ্ছে, অন্য একটা শিল্প বড় হয়ে উঠছে, এটা ভাল না মন্দ জানি না। বদলটা টের পাচ্ছি। আসলে কী জান, যেটা থেকে বেশি লোক বেনিফিট পাবে সেটাই এগিয়ে যাবে। যেমন আমার নাতি যদি তেমন করে মালয়ালম না শেখে, শিখবে না, আবার মালয়ালম শিখে যদি তার কিছু বেনিফিট হয় তা হলে শিখবে। মানুষ কেন ভাষা বা জীবিকার স্বার্থ দেখবে? মানুষ তো নিজের স্বার্থ দেখবে। যদি কোনও ভাষা বা জীবিকা লাভজনক হয়, তা হলেই তো মানুষ সে দিকে যাবে।’
ট্যাপিয়োকা, ভাত, ডাল, স্যালাড, দু’রকম মাছ, গোমাংস, সবজি, কলা, রাম দিয়ে সাজানো খাবার টেবিল। জিমির কথার মধ্যে যে কাণ্ডজ্ঞান রয়েছে, যা সে শিখেছে জীবন থেকে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। একদা খুব মন দিয়ে খ্রিস্টধর্ম পালন করত, এখন করে না; রাজনীতি করত, এখন করে না। তার সঙ্গে তর্ক করি না, কৃষির ভালমন্দ নিয়ে তর্ক করা বেরসিকতা হবে। কথা শুনি। মুনার নিঝুম থেকে আরও নিঝুম হয়। যে বিদেশি পুরুষ ও রমণীকে চার চাকার একটা বিচিত্রদর্শন সাইকেল প্যাড্ল করে পাহাড় চূড়োয় যেতে দেখেছিলাম, তাঁরা বোধহয় এতক্ষণে তাঁদের ঈপ্সিত রিসর্টে পৌঁছে গেছেন। বেঙ্গালুরুর ভারতীয়রা এই উইকএন্ডে এসেছেন মুনারে। এক সময় কথা থামে, উঠে পড়ি। খাদ্য পানীয় অভিজ্ঞতা নিষ্ণাত রাত্রি। বুড়ি পৃথিবীর ভালমন্দ বোঝা সহজ নয়। কোচি ছাড়ার আগে বিমানবন্দরে বসে এ কথাই মনে হল। ১৯২২-এ জনির কলেজে যখন এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তার পর তো মুনার দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। মালয়ালম ভাষায় ‘আর’ মানে নদী। জীবনের জলছবি। একটা দাগ মুছে যায়, আর একটা দাগ আসে। সেটাও কি থাকে! জলের কোনও দাগই চিরকাল থাকে না।
|
লেখক বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক |