অবলুপ্তির দিকে এগোচ্ছে বেনারসি
বুনকারদের হাল ফেরাতে পারবে কি নির্বাচন
কালচে লাল সাটিন সিল্কের জমিতে জরির অপূর্ব ‘ব্রোকেড’। ‘আহ্ বেনারসী, বাহ্ বেনারসী’! তানাবানার (তাঁতযন্ত্র) নিপুণ বুননে নয় গজের পিচে খেলছে সহস্র রেশমি সুতো! কে বলতে পারে, তিন হাত ঘুরে হয়তো আপনি এটিই কিনবেন! মেয়ের জন্য!
তোমার বয়স কত ভাই?
জুলফিকার এ বার মাথা নামিয়ে নিল। জুম্মাবার। স্নান করে, সাদা কুর্তা-পাজামা পরে সকালে নমাজ পড়েছে। চোখে সুরমা। পা ঝুলিয়ে বসে এখন এক মনে শাড়ি বুনছে। গত সাত দিনে শাড়ির আঁচল থেকে শুরু করে খোলের অনেকটাই হয়ে গিয়েছে। কম সে কম আরও সাত দিন লাগবে।
জুলফিকারের আব্বা রফিকউল্লাহ জবাব দিলেন, “ও আসলে একটু খাটো।” তবু জুলফি-র কচি মুখ দেখে ঠাওর করা যায়, বয়স বড় জোর বছর বারো। বয়স লুকনো এখানকার দস্তুর। নইলে শিশুশ্রমিকের দায়ে রফিকের হাজতবাসও হতে পারে।
কিন্তু আপনার মেয়ের বয়স কত?
জুলফি-র বয়সী হলে বলব, চিন্তার অল্পস্বল্প কারণ রয়েছে। মেয়ের বিয়েতে ভালো বেনারসি দেওয়ার সাধ থাকলে, এখনই কিনে ফেলুন! নইলে কে বলতে পারে মেয়ে যখন সমর্থ হবে, তখন বেনারসি হয়তো থাকবে মিউজিয়ামে! অথবা এমন আগুন দাম হবে যে, ছুঁতেই ভয় পাবেন! রফিক তো বটেই তত দিন জুলফি-ও বেনারসি বুনবে কিনা কে জানে!
‘বেনারস’ মানেই সেখানে বেনারসি শাড়ি বোনা হয়। আজন্মকালের আম-ধারণা এমনই। অথচ হাতে বোনা বেনারসি বুনকার খুঁজতে গিয়ে রীতিমতো গবেষণায় নামতে হল। বেনারস, জৌনপুর, আজমগড়, মউ, বাধোই, চান্দৌলিতে ১২ লক্ষ বুনকারের বাস। কুটিরশিল্পের মতোই ঘরে ঘরে বোনা হয় শাড়ি। বহু আগে সুতির শাড়ি বোনা হত। পরে মোগল প্রভাবে আবির্ভাব ঘটে সিল্ক ও জরির। ব্রোকেড, বুটিদার, তাঞ্চোই, কাটওয়র্ক, জামেওয়ার হরেক কিসিম। কিন্তু বেনারসি কই?
বারাণসী ছাড়িয়ে বাধোইয়ের পথে লোহতা তালুক। বাজার পেরিয়ে একটু এগোতেই রাস্তার দু’পাশে ঘটর ঘট শব্দ শুনে থামল গাড়ি। “স্যর, এখানেই শাড়ি বোনা হয়।” বাবা হাজি সাহেব রোদে চেয়ার টেনে বসে। এক মুখ জর্দা পান, “কাকে খুঁজছেন?” আজ্ঞে হ্যান্ডলুম। “হ্যান্ডলুম? সে তো আখরি শ্বাস নিচ্ছে। এখানে সব পাওয়ার লুম। সিন্থেটিক বা নকল সিল্কের শাড়ি।” আর বেনারসি? হাজি এ বার মস্করা করে জবাব দিলেন, “বানারসে যা হয় সবই তো বানারসি। আমরাও তো বানারসি বুনছি!” তবে কথা শেষ করেই গলা খাঁকারি দিয়ে আফজলকে হাক পাড়লেন, “ওনাকে রফিকের বাড়ি নিয়ে যা।”
লোহতায় হাজি রফিকুল্লাহ ছাড়া সাকুল্যে আর তিন-চার ঘরে আজও জীবিত হ্যান্ডলুম। আগে ঘরে ঘরে শুধু এই কাজই হত। এখন হ্যান্ডলুম বুনকার টেনেটুনে তিরিশ জন। বারো-চোদ্দো দিনে একটা শাড়ি বোনা হলে মজুরি মেলে বড়জোর দেড় থেকে পৌনে দু’হাজার। তাতে সংসার চলে? বহুমূল্য বেনারসি এখনও তৈরি হয় তাঁদের ঘরে। এমনকী ইদানীং জর্জেট কাপড়ে ‘কনটেম্পোরারি বেনারসি’ও তৈরি হচ্ছে কিছু। কিন্তু তাতে মজুরির হেরফের হচ্ছে কোথায়?
লোহতা থেকে চলে এলাম মদনপুরায়। আকবর মিঞা আকাশি সুতোয় জরির নকশা বুনছেন। এটা বুটিদার। জানতে চাইলাম, “কোন সিল্ক?” আকবরের জবাব, “চিনা বাবু। এটা একটু বেশি চিকনাই। এখানে এখন ওটাই চলে। দাম একটু কম পঁচিশ-ছাব্বিশশো টাকা কেজি। আবার মজবুতও।” লোহতাতেও তাই দেখেছি। সিল্কের বাজারের দখল নিয়েছে চিন। এর মধ্যে আবার চোরাই পথে আসা রেশমও নাকি রয়েছে। তাহলে দেশি সিল্কের বেনারসি? রামনগরের রেশম? অতিশয়োক্তি না করেও বলা যেতে পারে, কদিন বাদে হয়তো তার জন্য নিরুদ্দেশ সম্পর্কিত ঘোষণা সাঁটা হবে বেনারসের দেওয়ালে।
আকবর মিঞাও এ কাজ ছেড়ে দিতে চান। দিনভর সুতোর দিকে চেয়ে চেয়ে দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়েছে। জাতভাইয়েরা ইতিমধ্যেই এ পেশা ছেড়েছে। কেউ গঙ্গায় নৌকো চালান তো কেউ বাঙালিটোলায় রিকশা টানেন। পাওয়ার লুম বসানোর ক্ষমতা কোথায় সকলের?
তাহলে বাবা হাজি সাহেব নিশ্চয়ই ভালো আছেন! পানের পিক ফেলে বাবা সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। চলুন কারখানায়। ঘটর ঘট শব্দ ততক্ষণে থেমে গিয়েছে। চার জন মজুর বসে বিড়ি ফুঁকছেন। লোডশেডিং। দিনে চব্বিশ ঘণ্টার ১৫ ঘণ্টা এমনই থাকে। রোহতা এও জানাতে চায়, মুলায়ম জমানায় অবশ্য বিদ্যুতের এতটা ‘বুরি হাল’ ছিল না। হাজি জেনারেটর কিনেছিলেন। কিন্তু মহাজনের কাছে তার ‘উধার’ রয়েছে। নুন-পান্তার অভাব নেই। তবু এটাকে ‘বাঁচা’ বলে না। মউ, জৌনপুরে দেনার দায়ে আত্মহত্যার ঘটনাও ইদানীং ঘটছে বুনকর পরিবারে।
বারাণসী একটা নমুনা হিসাবে ধরলাম। পূর্ব উত্তরপ্রদেশের মতোই আলিগড়-সহ পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বুনকারদের বহু প্রজন্মের বাস। দুর্গতির চিত্রটাও বহু লক্ষ পরিবারের একই রকম। মোটামুটি ভাবে ‘ভিলেন’ দু’জন। এক লোডশেডিং! তো দুই, মহাজন বা ব্যাঙ্কের কাছে ধার। টাকা শোধের দায়ে ব্যবসা বিকোনোর জোগাড়!
সেই উত্তরপ্রদেশেই আবার ভোট এসেছে। সরকারের বিরুদ্ধে উষ্মা ফুলেফেঁপে উঠছে বুনকার মহলে। টিভি চ্যানেলে সমাজবাদী পার্টির বিজ্ঞাপন চলছে, ক্ষমতায় এলে বুনকারদের ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। রাহুল গাঁধী আবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরিবর্তে আগাম কিছু করে দেখাতে চেয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে গোটা দেশের তাঁতিদের জন্য প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ আদায় করে নিয়েছেন। তাতে তাঁতিদের দু’লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ মকুব হবে। নতুন ঋণ নিলে সুদে ছাড় মিলবে তিন শতাংশ। সেই প্রকল্পের জন্য বুনকার কার্ড তৈরির কাজও শুরু হয়েছিল। ভোটের জন্য এখন স্থগিত রয়েছে।
কিন্তু এই পরিবারগুলি তাদের ভালমন্দ বোঝে কী! হাজি সাহেব জানান দেন, “এখানে তো ভোট মানেই জাতপাতের অঙ্ক কষা। তা ছাড়া যথাপূর্বং তথা পরং। তবে ঋণ মাফি হলে কিছু পরিবার বাঁচবে বই কি।” আকবর মিঞা অবশ্য বুনকার কার্ডও বানাতে চান না। বরং হতাশ মুখে জবাব দেন, “কী হবে? খোঁজ নিয়ে দেখুন রিকশাওয়ালা, সবজিওয়ালারও কার্ড পেয়েছে।” আর ঋণ নিলেই বা কী? মজুরি তো সেই দিনে দেড়শো টাকা!
আর বেনারসি? ওই যে হাজি সাহেব জানিয়ে দিয়েছিলেন, বানারসে সবই বানারসি। সে সিল্ক হোক বা সিন্থেটিক। চিনা বা জাপানি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.