নদিয়ার মাজদিয়া কলেজের এসএফআই সমর্থক তিন ছাত্রকে ‘নিঃশর্ত জামিনে’ মুক্তি দিল কলকাতা হাইকোর্ট। ৭ জানুয়ারি থেকে তাঁরা জেল-হাজতে রয়েছেন। ওই তিন ছাত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা সরকারি কর্মচারীর (কলেজের অধ্যক্ষ) কাজে বাধা দিয়েছেন এবং হেনস্থা করেছেন। ভারতীয় দণ্ডবিধিতে জামিন-অযোগ্য ৩৫৩ ধারায় পুলিশ প্রণব ঘোষ, অভিজিৎ হালদার ও পুষ্পেন সরকার নামে ওই তিন ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা করে। নিম্ন আদালত পরপর তিন বার তাঁদের ১৪ দিনের জেল-হাজতের নির্দেশ দিয়েছিল।
বিচারপতি কাঞ্চন চক্রবর্তী ‘বিস্ময়’ প্রকাশ করলেও রায়ে নিম্ন আদালত সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করেননি। তবে বলেছেন, কেস ডায়েরি থেকে বোঝা যায়, তদন্তের স্বার্থে ধৃতদের আটকে রাখার যুক্তি নেই। বৃহস্পতিবার শুনানির সময় কার্যত কোনও বিরোধিতা করেননি সরকারি আইনজীবীরাও। যদিও নিম্ন আদালতে তাঁরা পুলিশের দাবি অনুসারে প্রতি বারেই জামিনের বিরোধিতা করেছিলেন।
প্রায় একই সময়ে রায়গঞ্জ, রামপুরহাট-সহ বেশ কয়েকটি কলেজে অধ্যক্ষ নিগৃহীত হন। কিন্তু মাজদিয়া ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে পুলিশ জামিনযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করে। মাজদিয়ার ছাত্রদের ক্ষেত্রে অন্য ধারার সঙ্গে একটি জামিন-অযোগ্য ধারা যুক্ত করা হয়। যার থেকে অভিযোগ ওঠে, রায়গঞ্জে শাসক দলের ছাত্র সংগঠন জড়িত ছিল বলে ‘লঘু ধারা’ দেওয়া হয়। তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিংসার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন। ঘটনাচক্রে, এ দিনই শান্তিনিকেতনে রাজ্যপাল বলেছেন, “শিক্ষাঙ্গনে এখন উদ্বেগজনক পরিস্থিতি নেই।” |
জামিনের আবেদন জানিয়ে ওই এসএফআই সমর্থকদের আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য ও সায়ন দে বলেন, ধৃতেরা সকলেই ছাত্র। তাঁদের কোনও অপরাধের ইতিহাস নেই। যে ধারায় তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে, সেই ধারায় দোষী প্রমাণিত হলেও সর্বোচ্চ দু’বছর কারাদণ্ড হতে পারে। অথচ ইতিমধ্যেই তাঁদের এক মাসের বেশি জেল-হাজতে রাখা হয়েছে। যে-এফআইআরের ভিত্তিতে পুলিশ অভিযোগ দায়ের করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, একটি ধারা লেখার পরে তা কেটে দিয়ে ৩৫৩ ধারা দেওয়া হয়েছে। আইনজীবীদের বক্তব্য, পুলিশ ঘটনার গুরুত্ব অনুযায়ী প্রথমে জামিনযোগ্য ধারা দিলেও পরে তা কেটে জামিন-অযোগ্য ধারা দিয়েছে। তবে নদিয়ার পুলিশ সুপার সব্যসাচী রমণ মিশ্র বলেন, “বিষয়টি হাইকোর্টে বিচারধীন। তাই মন্তব্য করব না।”
মাজদিয়ার ছাত্রদের জামিনের প্রেক্ষিতে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের প্রতিক্রিয়া, “মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় ‘ছোট্টদের’ প্রতি প্রতিহিংসার মনোভাব নিয়েছিল সরকার। দুর্ভাগ্য যে, তাদের হাইকোর্ট পর্যন্ত যেতে হল। সরকার যদি হাইকোর্টে জামিনের বিরোধিতা না-করে থাকে, তা হলে বুঝতে হবে, হাত পুড়িয়ে তারা এই পথ নিয়েছে! সরকারের মতিগতির কোনও পরিবর্তন হয়েছে, এমন মনে করার কারণ নেই!” ভাঙড়ে সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষক সভার রাজ্য নেতা তুষার ঘোষের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে সূর্যবাবু বলেন, “তৃণমূলের বিখ্যাত এক জন (আরাবুল ইসলাম) বলেছেন, দেখে নেওয়া হবে! তাঁকে গ্রেফতার করা হোক। তা হলেই বোঝা যাবে, সরকারের মতিগতি বদলেছে। পুলিশ-প্রশাসন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া কাজ করছে।”
৭ জানুয়ারি মাজদিয়া সুধীরঞ্জন লাহিড়ি কলেজের অধ্যক্ষ সরোজেন্দ্রনাথ করকে নিগ্রহ করা হয় বলে তিনি নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ থানায় এসএফআইয়ের পাঁচ ছাত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। সেই রাতেই তিন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। তার পর থেকে তাঁরা জেল-হাজতেই রয়েছেন। সরোজেন্দ্রবাবু বলেন, “পুলিশকে ঘটনাটা জানিয়েছিলাম। কিন্তু কী ধারা দেওয়া হবে এবং তার দরুন ওই ছাত্রেরা জামিন পাবেন কি না, তা প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থার বিষয়।” সরকারি কৌঁসুলি দেবাশিস রায় ও আইনজীবী বিনয় পাণ্ডা হাইকোর্টে জামিনের বিরোধিতা করেননি। বিচারপতির রায়েও সরকার পক্ষের বক্তব্য উল্লেখ করা হয়নি। বিচারপতি বলেন, ধৃতেরা এমন অপরাধ করেননি, যাতে তাঁদের এত দিন আটকে রাখতে হবে। কেস ডায়েরি দেখে এবং সব দিক বিবেচনা করে ধৃতদের নিঃশর্ত জামিনে মুক্তি দেওয়া হল।
জামিন ঘিরে এ দিনও রাজনৈতিক চাপান-উতোর চলেছে। এসএফআইয়ের সাধারণ সম্পাদক ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “জামিন পাওয়াটা নিঃসন্দেহে আনন্দ ও স্বস্তির ব্যাপার। তবে এই ঘটনায় আরও এক বার দলতন্ত্রের নির্লজ্জ চেহারা সামনে এল!” তৃণমূল ছাত্র পরিষদের উপদেষ্টামণ্ডলীর চেয়ারম্যান বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় পাল্টা বলেন, “সম্প্রতি সুশান্ত ঘোষকেও তো জামিন দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। জামিন মানে তো আর রেহাই পাওয়া নয়।”
|