কোনও সার্বভৌম দেশে যদি কখনও আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ করিতেই হয়, তাহার নিশ্চয়ই একটি সুবৃহৎ সংকট থাকিতে হইবে। এমনই সুবৃহৎ হইবে সেই সংকট যে তাহা লইয়া অধিকাংশ রাষ্ট্রের কোনও সংশয়ই থাকিবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন রাষ্ট্রপুঞ্জের নিয়মাবলি নির্ধারিত হয়, তখন বিষয়টি এ ভাবেই আলোচিত হইয়াছিল। অথচ দেখা যাইতেছে যে, যেখানে সত্য সত্যই সংকট ভয়াবহ আকার লাভ করিয়াছে, যেখানে প্রতিটি দিন অতিবাহিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে বিপদ আরও গভীরতা লাভ করিতেছে, সেখানে কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জ এখনও আশ্চর্য রকম নিষ্ক্রিয়। ২০১১-র মার্চ হইতে নিরন্তর রক্তক্ষয়ের দেশ সিরিয়ায় আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের সময় হইয়া গিয়াছে, বাস্তবিক, সে সময় পার হইয়া গিয়াছে। এখনও যদি এই নিষ্ক্রিয়তা চলিতে থাকে, তবে ভবিষ্যৎ ইতিহাস বহিঃপৃথিবীর দায় ভুলিতে পারিবে না। উল্লেখ্য, অধিকাংশ দেশ হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা লইয়া নিশ্চিত হইলেও নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো-ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রস্তাব আটকাইয়া দিয়াছে চিন এবং রাশিয়া। সেক্রেটারি-জেনারেল বান-কি মুন-এর বারংবার ব্যক্তিগত অনুরোধ সত্ত্বেও পরিস্থিতি পাল্টায় নাই। রাশিয়া যে সিরিয়া কর্তৃপক্ষের বিশিষ্ট মিত্র, তাহা সর্বজ্ঞাত। দামাস্কাস সর্ব রকমের সামরিক, অর্থনৈতিক সহায়তা পাইয়া থাকে মস্কো হইতে। স্বভাবতই মস্কো দামাস্কাসে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের বিরোধী, এবং সেই বিরোধিতার যুক্তি: হস্তক্ষেপ হইলে অবস্থা আরও ভয়ানক দাঁড়াইবে। চিন-এর ক্ষেত্রটি আলাদা। নিজের অবস্থানের কারণেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে কোনও ধরনের নাগরিক আন্দোলনকে মানবাধিকারের যুক্তিতে সমর্থন: চিনের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।
সিরিয়ার ক্ষেত্রে এ-হেন নিষ্ক্রিয়তা সিরিয়ার পক্ষে ভয়ানক তো বটেই, কিন্তু বিষয়টির গুরুত্ব তাহার অপেক্ষাও বড়। এই ঘটনা তর্জনী তুলিয়া দেখাইয়া দেয়, বিশ্বময় প্রায়-ঐকমত্য তৈরি হওয়া সত্ত্বেও একটি বা দুটি অতি-ক্ষমতাশালী দেশ কী ভাবে সেই ঐকমত্য-পথকে রুদ্ধ করিয়া দিতে পারে। সেই রোধকারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হইতে পারে কখনও চিন-রাশিয়া, কখনও আমেরিকা-ব্রিটেন। ছোট-বড় সব দেশকেই যখন মত-প্রকাশের অধিকার ও অবকাশ করিয়া দেওয়া রাষ্ট্রপুঞ্জের লক্ষ্য, সেখানে এই ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক তো নহেই, অত্যন্ত অসঙ্গত ও অসুবিধাজনকও বটে। রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষমতার কৌশলগত আঁতাত সমানেই নানা ভাবে ন্যায় ও নিরাপত্তার পথ আগলাইয়া দাঁড়াইতে পারে, এই পরিস্থিতি তাহা অভ্রান্ত ভাবে দেখাইয়া দেয়।
অথচ, সিরিয়ার জনসাধারণের উপরে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ-এর চরম প্রশাসনিক দমননীতি যে পর্যায়ে গিয়া পৌঁছাইয়াছে, তাহাতে শীঘ্রই সে দেশে গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হইবার ঘোর সম্ভাবনা। কেবল তাহাই নহে, পার্শ্ববর্তী আরও কয়েকটি দেশেও দ্রুত যুদ্ধ ছড়াইয়া পড়িবার বাস্তব আশঙ্কা। প্রধানত সুন্নি জনগোষ্ঠী-অধ্যুষিত দেশটিতে শিয়া-গোষ্ঠীভুক্ত শাসক ও তাঁহার এলিট বৃত্তের এই দ্বন্দ্বের বৎসরব্যাপী রক্তাক্ত হানাহানি নিশ্চিত ভাবে ইরাক ও লেবাননে উত্তেজনা তৈরি করিতেছে। সিরিয়ার অবস্থা হাতের বাইরে চলিয়া গেলেও সুন্নি-শিয়া তিক্ততাকীর্ণ ওই দুই দেশও শান্ত থাকিবে না। পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির এই পরস্পর-সংযুক্ত রাজনৈতিক অস্থিতি খেয়ালে রাখিয়াই দ্রুত সাবধানতা দরকার ছিল। ইহাও পর্যালোচনা করা উচিত ছিল যে, আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ মানে কি কেবলই সামরিক পন্থা অবলম্বন, নাকি আরও কিছু গত্যন্তর আছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ তাহার গতানুগতিক পথ ছাড়িয়া আর একটু যুগোপযোগী না হইয়া উঠিলে এত বড় আকারের সংকট সামলানো ক্রমশই অসম্ভব হইয়া দাঁড়াইবে। |