রাজ্যে পরিবর্তনের পরে তাঁকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করেই তৈরি হয়েছিল অন্তত গোটা দশেক যাত্রাপালা। অথচ সেই তিনি, ‘মা-মাটি-মানুষে’র মুখ্যমন্ত্রী
অনুপস্থিত থেকে গেলেন যাত্রা উৎসবে। উৎসবটুকু কোনও ক্রমে হলেও অর্থাভাবে ধুঁকছে পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা আকাদেমি। মা-মাটি-মানুষের সরকারের প্রতি অভিমান জমছে যাত্রাপাড়ায়।
২০০৯-২০১১ টানা তিন বছর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকায় অভিনয় করে আসছেন সীতা ঘোষ। ‘মা-মাটির লড়াই (২০০৯)’ এবং ‘নতুন সকাল আসছে (২০১০)’ পালায় রেকর্ড সংখ্যক শো করার পরে ২০১১-য় তাঁর অভিনয়ে শুরু হয়েছে পালা, ‘বাংলার মসনদে মমতা’। যাত্রা উৎসবে সেই পালা অভিনয়ের শেষে মঞ্চে দর্শকের সামনে দাঁড়িয়েই অভিমান উগরে দিয়েছেন সীতা। বলেছেন, “আমরা মা-মাটি-মানুষের কথা বলি। অথচ
আমাদের পালা দেখতে আসার সময় পেলেন না মুখ্যমন্ত্রী।” পরে সীতাদেবীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “যাত্রাশিল্পের সামগ্রিক অবস্থাই খুব শোচনীয়। আমি সকলের হয়েই আবেদন করছি, মুখ্যমন্ত্রী কিছু করুন।” |
অর্থাভাবের কথা এক বাক্যে স্বীকার করলেন যাত্রা আকাদেমির যুগ্মসচিব পল্লব মুখোপাধ্যায়ও। ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ মঞ্চে বাৎসরিক যাত্রা উৎসব মঙ্গলবারে শেষ হয়েছে। ২৫ দিনের এই উৎসবের বাজেট ছিল, পল্লব জানালেন, মাত্র ৬ লক্ষ টাকার মতো। তাঁর কথায়, “সিনেমা-নাটকের উৎসবে কত টাকাই তো খরচ হচ্ছে! যাত্রাশিল্পে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের রুটিরুজি জড়িত। তাদের কী হবে?”
রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০০৫ সালে স্ব-শাসিত যাত্রা আকাদেমি গঠনের সময় বলা হয়েছিল, উৎসব করা ছাড়াও যাত্রাশিল্প এবং শিল্পীদের উন্নতির জন্য কর্মশালা-আলোচনা সভা-প্রশিক্ষণ এবং প্রকাশনার নিয়মিত ব্যবস্থা থাকবে। ছ’বছরে হাতে গোনা কয়েকটি কর্মশালা ছাড়া আর কিছুই হয়নি। শেষ কর্মশালা কবে হয়েছে, তা আকাদেমির কর্মীরা বলতে পারছেন না। খাতায়কলমে একটি সংগ্রহশালা থাকলেও, সেখানে প্রায় কিছুই নেই। সংগ্রহশালা দেখতে চাইলে আকাদেমির কর্মীরা বলেন, “একটা ঘর রয়েছে বটে। কিন্তু সেই ঘরে রাখার মতো যাত্রার পোশাক এবং সাজ-সরঞ্জাম সেভাবে এখনও পর্যন্ত সংগ্রহ করে ওঠা যায়নি।’’ সামান্য কয়েকটি বই নিয়ে একটি গ্রন্থাগার রয়েছে। কোনও গ্রন্থাগারিক নেই। ফলে গ্রন্থাগারটি নিয়মিত খোলারও কোনও প্রশ্নই নেই বলে জানালেন কর্মীরা।
বছরে মাসখানেক যাত্রা উৎসব ছাড়া ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ মঞ্চেও যাত্রা হয় না। সভা, জলসা, সঙ্গীতানুষ্ঠানের জন্য মঞ্চটি ভাড়া দেওয়া হয় বলে জানান আকাদেমির সবচেয়ে পুরনো কর্মী কাশীনাথ চক্রবর্তী। প্রেক্ষাগৃহের বাতানুকূল যন্ত্রগুলির অধিকাংশই খারাপ হয়ে গিয়েছে। মঞ্চের শব্দ-প্রক্ষেপণ ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় রয়েছে। মঞ্চ ভাড়া নিলে শব্দ-প্রক্ষেপণের ব্যবস্থা বাইরে থেকে করতে হয় বলে আকাদেমির অন্য এক কর্মী জানান।
কেন এমন অচলাবস্থা? যাত্রা আকাদেমির সদস্য-সচিব নবারুণ সরস্বতী বলেন, “অর্থের অভাব, কর্মীর অভাব এবং স্থানাভাবই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। মাত্র চার জন কর্মী নিয়ে কাজ করতে হয়। ইচ্ছে থাকলেও কিছু করে ওঠা কঠিন।” দুঃস্থ শিল্পীদের আর্থিক সাহায্য দেওয়া আকাদেমির অন্যতম ঘোষিত লক্ষ্য! কিন্তু শিল্পীদের জন্য বরাদ্দ বছরে ৬ হাজার টাকা মাত্র! আকাদেমির বর্তমান কর্তারা এই অবস্থার জন্য আগের সরকারকেই দায়ী করছেন। রাজ্যে পালাবদলের পর আকাদেমির নতুন কমিটির অন্যতম কর্তা এবং যাত্রা উৎসবের সম্পাদক কনক ভট্টাচার্য বলেন, “আগে যা হয়নি, তা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাই না। যে সব উদ্দেশ্য নিয়ে আকাদেমি তৈরি হয়েছিল, তা বাস্তবায়িত করার জন্য যা করা দরকার তা-ই করব।”
যাত্রা উৎসবের মধ্যে আসতে না পারলেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শীঘ্রই আকাদেমির সদস্যদের সঙ্গে বসবেন বলে আশ্বাস মিলেছে। সেখানে দুঃস্থ শিল্পীদের জন্য অনুদানের পরিমাণ বাড়ানো এবং যাত্রাশিল্পের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান চাওয়ার কথা আলোচনা হবে। কলকাতা-কেন্দ্রিকতা ভেঙে জেলায় যাত্রা উৎসব করার পরিকল্পনা চলছে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের পাশে দাঁড়াবেন বলে আশা করছে যাত্রা আকাদেমি। |