‘ওঁরা-আমরা’র দিন সত্যিই ফুরিয়েছে কি না, উত্তরবঙ্গের তিনটি সরকারি উৎসবকে ঘিরে এ বার সেই প্রশ্ন উঠল কলাকুশলী মহলে। ওই তিনটি সরকারি উৎসবের মধ্যে রাজ্য ভাওয়াইয়া উৎসব এবং চা বাগিচা উৎসব বাম আমলে শুরু হয়েছে। এ বারই প্রথম শুরু হচ্ছে উত্তরবঙ্গ উৎসব। শিল্পীদের একাংশের অভিযোগ, বাম আমলে ভাওয়াইয়া উৎসবে ডাক পেয়েছেন এমন বহু শিল্পীকে বেছে বেছে এ বার ডাকা হচ্ছে না। উত্তরবঙ্গ উৎসবেও ডাকা হচ্ছে বাছাই করা শিল্পীদের।
বাম আমলে ডাক পাওয়া শিল্পীরা সকলেই বাম সমর্থক ধরে নিয়ে রাজ্য সরকার আমন্ত্রণের ক্ষেত্রে ‘ওঁরা-আমরা’ নীতি গ্রহণ করেছেন কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন ক্ষুব্ধ ওই শিল্পীরা। এঁদের মধ্যে কোচবিহারের নবীন-প্রবীণ ভাওয়াইয়া শিল্পীরা যেমন রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন বালুরঘাটের নাট্যকর্মী থেকে ডুয়ার্সের আদিবাসী শিল্পীরা।
রাজ্য ভাওয়াইয়া উৎসবের জন্মকাল থেকে তার সঙ্গে জড়িত জলপাইগুড়ির কংগ্রেস বিধায়ক সুখবিলাস বর্মা। এ বার উৎসব কমিটির সভাপতি পদে তাঁকে রাখার কথা হলেও পরে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। উৎসব আয়োজনের প্রক্রিয়া ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাঁর আপত্তির কথা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পরে সুখবিলাসবাবুকে অনুষ্ঠানে গান গাওয়ানোর জন্য চেষ্টা করছেন উদ্যোক্তারা। উৎসবের একেবারে শেষ দিনের শেষ শিল্পী হিসাবে তাঁর নামও ছাপা হয়েছে। ভাওয়াইয়া উৎসব কমিটির সভাপতি তথা তৃণমূল বিধায়ক বিনয়কৃষ্ণ বর্মনের বক্তব্য, “সুখবিলাসবাবু যেখানে চাইবেন সেখানেই অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। তবে সুখবিলাসবাবু জানিয়েছেন, ‘পারিবারিক ব্যস্ততা’র কারণে তাঁর যাওয়া অনিশ্চিত।” |
দেশের ২৩০টি রেডিও স্টেশনের মধ্যে লোকসঙ্গীত প্রতিযোগিতায় গত বছর প্রথম হন ডুয়ার্সের শিল্পী অনিন্দিতা রায়। তার আগের বছর তিনি দোতারায় জাতীয় পুরস্কার পান। এ বার ভাওয়াইয়া এবং উত্তরবঙ্গ উৎসবের ব্যবস্থা দেখে তিনি ক্ষুব্ধ। বললেন, “কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই আমার সরাসরি কোনও যোগাযোগ নেই। তবুও ডাক পেলাম না।” এ পর্যন্ত রাজ্যে ২২ বার রাজ্য ভাওয়াইয়া উৎসব হয়েছে। তার মধ্যে ১৮ বার উৎসবে ডাক পেয়েছিলেন ভাওয়াইয়া শিল্পী চৈতন্যদেব রায়। তিনি এ বারের উৎসবকে ‘দলতন্ত্র’-এর নমুনা বলে
অভিযোগ করেছেন।
আদিবাসী বিকাশ পরিষদের কুমারগ্রাম ব্লক সভাপতি বিনয় মিনজ অভিযোগ করেন, “উৎসবের মূল দায়িত্বে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা কেউ আদিবাসী নন। এটা কেমন আদিবাসী উৎসব হচ্ছে?” উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক তথা লোকসংস্কৃতি গবেষক দীপক রায় অভিযোগ করেন, “উৎসবে আমন্ত্রণের মাধ্যমে লোকশিল্পীদের মধ্যে ‘ওঁরা-আমরা’ বিভাজন তৈরির চেষ্টা হয়েছে।’’
বৃহস্পতিবার শুরু হচ্ছে রাজ্য ভাওয়াইয়া উৎসব। ১০ ফেব্রুয়ারি শিলিগুড়িতে উত্তরবঙ্গ উৎসব এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি ডুয়ার্সে চা বাগিচা উৎসব। ১১ ফেব্রুয়ারি মালদহে উত্তরবঙ্গ উৎসব শুরু হবে। মালদহ জেলার ডোমনি লোকসংস্কৃতি দল ‘মানিকচক লৌকিক সৃজনী।’ দলটি রাজ্যের বিভিন্ন জেলা, এমনকী দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ডে ১৯৮৪ সাল থেকে পালা করছে। উত্তরবঙ্গ উৎসবে তারা ডাকই পায়নি। সংস্থার সম্পাদক শচীন মণ্ডল বলেন, “কোথায় উত্তরবঙ্গ উৎসব হচ্ছে জানি না। আমরা আমন্ত্রণ পাইনি।” জেলার একটি গম্ভীরা দলকে অবশ্য ১০ ফেব্রুয়ারি শিলিগুড়িতে আসতে বলা হয়েছে। দলের সম্পাদক প্রশান্ত শেঠ বলেন, “১০ তারিখ বেলা ১১টায় আমাদের শিলিগুড়িতে যেতে বলা হয়েছে। কিন্তু কোথায় অনুষ্ঠান করব, সেই ব্যাপারে কিছুই জানানো হয়নি।” মালদহের জেলাশাসক শ্রীমতী অর্চনা জানিয়েছেন, ১১ ফেব্রুয়ারি মালদহের বৃন্দাবনী মাঠে উত্তরবঙ্গ উৎসবের সূচনা হবে। কখন, কোথায়, কী অনুষ্ঠান হবে তা কার্ড ছেপে আসার পর বিলি করলেই জানা যাবে।
উৎসবে আমন্ত্রণ না-পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে দুই দিনাজপুরের নাটক, যাত্রার দলের মধ্যেও। তৃণমূলের উত্তর দিনাজপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক অরিন্দম সরকার বলেন, “রাজ্য সরকার জেলাভিত্তিক উত্তরবঙ্গ উৎসবের অনুষ্ঠান সূচি চূড়ান্ত করে জেলা প্রশাসনকে পাঠিয়েছে। দলের তরফে রাজ্য সরকারের কাছে জেলার শিল্পীদের ওই অনুষ্ঠানে সুযোগ দেওয়ার আর্জি জানিয়েছি।” দক্ষিণ দিনাজপুরের এক তৃণমূল নেতা শিল্পীদের ক্ষোভ সামাল দিতে এ দিন স্থানীয় একটি নাটকের দলকে আমন্ত্রণ জানানোর ব্যবস্থা করেন। ওই নেতা জানান, যে ভুল-ত্রুটি ধরা পড়ছে তা আগামী বছর শুধরে নেওয়া হবে। |