সূর্য-সুশান্তকে সামনে রেখে দ্বিমুখী রণকৌশল সিপিএমের
সুশান্ত ঘোষকে ‘বীরের মতো বরণ’ করার ঘটনা নতুন করে বিতর্ক উস্কে দিল সিপিএমে।
সম্প্রতি শুদ্ধকরণ দলিল প্রকাশ করেছে সিপিএম। সোমবার প্রকাশ হয়েছে দলের মতাদর্শগত দলিলও। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সুশান্ত ঘোষকে বিশেষ রাজনৈতিক মর্যাদা দেওয়ায় দলের একাংশের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, তাঁকে যদি এই মর্যাদা দেওয়া হয়, তা হলে শুদ্ধকরণের কর্মসূচি নেওয়ার প্রয়োজনটা কি? যাঁরা ‘ভুল’ বুঝে চলে গিয়েছেন, এই ভাবে কি তাঁদের ফেরানো সম্ভব হবে? বাড়ানো যাবে দলের গণভিত্তি? ২৩তম রাজ্য সম্মেলনের আগে এই প্রশ্ন ঘিরেই এখন সরগরম সিপিএম।
এর জবাবে দলের এক পক্ষের বক্তব্য, গত কাল যাঁরা সুশান্তকে গোলাপ দিয়ে বরণ করেছেন, তাঁরা মূলত ছাত্র-যুব। এর সঙ্গে সিপিএম নেতৃত্বের যোগ নেই। কিন্তু সেই যুক্তিও যে খাটছে, তা নয়। কারণ, ছাত্র-যুবদের মধ্যে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা নেতৃস্থানীয়। তাঁদের কাউকে কাউকে এর মধ্যেই প্রার্থী করেছে সিপিএম। তা ছাড়া ছিলেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত, ছিলেন দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর আরও দুই সদস্য, রবীন দেব ও পশ্চিম মেদিনীপুরের দীপক সরকার।
দলের তরফে আর এক পক্ষ কিন্তু বলছে, শহুরে ভদ্রলোক থেকে ক্যাডার, সব ক্ষেত্রে জনভিত্তি বাড়িয়ে নিজেকে শক্তিশালী করতে এখন এই দ্বিমুখী রণকৌশলই নিয়েছে সিপিএম। এক দিকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, নিরুপম সেন বা সূর্যকান্ত মিশ্রকে সামনে রেখে শহুরে ভদ্রলোকদের টেনে আনার চেষ্টা হবে। সেখানে বোঝানো হবে, দল যেমন বুদ্ধ-নিরুপমের শিল্পায়নের নীতিতে ভরসা রেখেছে, তেমনই সূর্যকান্তের মাধ্যমে দায়িত্বশীল বিরোধী দলের দায়িত্বও পালন করছে। অন্য দিকে, সুশান্ত ঘোষ-দীপক সরকার বা লক্ষ্মণ শেঠদের মতো নেতাদের গুরুত্বও বজায় রাখা হবে। কারণ, দলের ক্যাডারকূল ধরে রাখতে এই নেতাদের প্রয়োজন। প্রয়োজন তৃণমূলের সঙ্গে মোকাবিলা করে গ্রামীণ ভোটব্যাঙ্ক পুনরুদ্ধারের জন্যও। মেদিনীপুরের এক সুশান্ত-ঘনিষ্ঠ ডাকাবুকো নেতা বলছিলেন, “মায়কোভস্কি দিয়ে তো আর শুভেন্দু অধিকারীর মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। সেখানে লক্ষ্মণ শেঠ বা সুশান্ত ঘোষকেই দরকার।”
বস্তুত, সুশান্ত ঘোষরা যে ‘লাইন’ নিয়ে চলেন, বুদ্ধবাবু বরাবরই তার বিরোধী। সুশান্তকে তিনি যে মন্ত্রিসভায় নিয়েছিলেন, পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রী করেছিলেন, তার বড় কারণ, সুশান্ত জ্যোতি বসুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তা ছাড়া পার্টিও চেয়েছিল। আবার পার্টি চেয়েছিল বলেই কেশপুর-গড়বেতায় তৃণমূলের সঙ্গে টক্কর দেওয়া সুশান্তকে নন্দীগ্রামেও মাঠে নামানো হয়েছিল। দলের একটি অংশ সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছে, ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে যে দলের ২৩তম রাজ্য সম্মেলন এবং ১৯শে ব্রিগেড, সেখানে ক্যাডারবাহিনীকে চাঙ্গা করতে সুশান্তকে প্রয়োজন।
দিল্লিতে অনেকে বলছেন, এটা যেন অনেকটাই বিজেপির রাজনীতির মতো। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে। তার আগে উমা ভারতী, সাধ্বী ঋতাম্বরারা ছিলেন দলের উগ্র হিন্দুত্ববাদী মুখ। আবার উল্টো দিকে অটলবিহারী বাজপেয়ী ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ মুখ। জেতার পরে বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু দলের অন্য মুখকে তিনি একেবারে ছেঁটে ফেলতে পারেননি। এখন আবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা বিজেপি সভাপতি নিতিন গডকড়ী উত্তরপ্রদেশে মায়াবতীর তাড়িয়ে দেওয়া দুর্নীতিগ্রস্তকে জায়গা দিয়ে ভারসাম্য রাখছেন। সিপিএমের সমস্যাও এমনই। তাই শুদ্ধকরণের কথা বললেও সুশান্তদের বিশেষ সম্মান দেখাতে হয়। কারণ, তাঁদের হাতে যে ক্যাডারবাহিনী রয়েছে, তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই বুদ্ধবাবু বা প্রকাশ কারাট, কারওরই।
দলের যে অংশটি প্রশ্ন তুলছে, তাদের বক্তব্য, শুধু ক্যাডারভিত্তি দিয়ে তো ভোটে জেতা যায় না। না হলে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও তো গোঁড়া সমর্থকরা দলকে ভোট দিয়েছেন। তখন দল জেতেনি কেন? দলও এখন গণভিত্তি বাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। জেলায় জেলায় গিয়ে বুদ্ধবাবু, বিমান বসুরা সেই কথাটাই বারবার বলছেন। সুশান্ত ফিরলে কি সেই জনভিত্তি ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে?
দলের এই উভয়সঙ্কটের কথা মেনে নিচ্ছেন দলীয় নেতৃত্বের একাংশ। সিপিএমের এক শীর্ষ নেতা দুঃখ করে বললেন, “আমাদের এই সঙ্কটটা বিজেপি-র ‘হিন্দুত্ব ছাড়ব কি ছাড়ব না’-এর মতো। ওদের অবস্থা ‘বেড়াল বলে মাছ খাব না’। আমাদেরও হাত-পা বাঁধা। তাই যে যা-ই বলুক, লক্ষ্মণ-সুশান্তকে ছাড়া চলবে না।”
এ কথাটা সুশান্ত ঘোষ নিজেও জানেন। সুশান্ত-ঘনিষ্ঠরা বলেন, “মাঠেঘাটে নেমে, লোক জড়ো করার কাজটা কিন্তু এই নেতাদেরই করতে হয়।” তাই জেল থেকে বেরিয়ে রাজনৈতিক সম্মান পেয়েও তিনি সংযত। পাশাপাশি দলের মধ্যেই একটা অংশ বলছে, হঠাৎ করে মতাদর্শগত দলিল প্রকাশ আর সুশান্তর মুক্তিকে এক পংক্তিতে এনে দেখানো হচ্ছে কেন, কে জানে! ১৯৮৬ সালে সল্টলেকের পার্টি কংগ্রেসের আগে উত্তর ২৪ পরগনায় দলীয় কোন্দল ছিল তুঙ্গে। সেই পার্টি কংগ্রেসে ঠিক হয়েছিল, এই ধরনের কোন্দল, মারদাঙ্গা থেকে দূরে থাকবে পার্টি। কিন্তু তার পর ২৫ বছর কেটে গিয়েছে। দল কি আদৌ এই সমস্যা থেকে বেরোতে পেরেছে?
এখানেও তাই দু’দিক রেখেই চলতে হবে। বুদ্ধবাবুদের নীতি থেকে দল যেমন সরবে না, তেমনই সুশান্ত ঘোষদেরও প্রয়োজন। এই ক্যাডারভিত্তি আছে বলেই দীপক সরকারকেও সরাতে পারেনি দলীয় নেতৃত্ব। আর ১৮১ দিন জেল খেটে বেরনোর পরে আবির-গোলাপ দিয়ে বরণ করতে হয়েছে সুশান্তকে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.