|
|
|
|
শোভনদেবের ডানা ছাঁটলেন মমতা, ধমক দিলেন মেয়র শোভনকেও |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
দলের দীর্ঘদিনের শ্রমিক নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে সরিয়ে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের (আইএনটিটিইউসি) সর্বভারতীয় সভাপতি পদে রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে এলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশিই, সংগঠনের রাজ্য শাখার চেয়ারম্যান পদে আনা হয়েছে শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুকে। যে নিয়োগকে তৃণমূলের অন্দরে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে সংগঠনের সভানেত্রী দোলা সেনের ‘মাথায় বসিয়ে দেওয়া’ হিসেবেই।
বুধবার মহাকরণে এক বৈঠকে ওই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। ঘটনাচক্রে, সেই বৈঠকেই মুখ্যমন্ত্রীর কড়া সমালোচনার মুখে পড়েন কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়।
|
শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় |
|
শোভন চট্টোপাধ্যায় |
তৃণমূল সূত্রের খবর, কলকাতা পুরসভার কাজে ‘অখুশি’ মুখ্যমন্ত্রী সর্বসমক্ষেই মেয়রকে ‘ভর্ৎসনা’ করেন। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা ওই কথা জানিয়ে বলেন, নেত্রী এমনও বলেছেন যে, ‘ব্যক্তিগত’ স্তরে শোভনবাবু তাঁর ‘ঘনিষ্ঠ’ বলেই যে তাঁর কাজের কোনও মূল্যায়ন হবে না বা তিনি কাজ না-করলে তা মুখ্যমন্ত্রীর ‘নজর এড়িয়ে’ যাবে, তা নয়। বস্তুত, সম্প্রতি মেয়রের উপর কাজের ভার ‘লাঘব’ করতে তাঁর অধীন কিছু দফতর পুনর্বিন্যস্ত করে সেগুলি অন্য মেয়র পারিষদদের হাতে দিয়েছেন মমতা। এ দিনের বৈঠকে সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করেও সর্বসমক্ষেই মুখ্যমন্ত্রী মেয়রকে বলেন, তিনি যদি ‘পারফর্ম’ করতে না-পারেন, তা হলে বাকি দফতরগুলির ভার ‘লাঘব’ করা হতে পারে। মেয়র অবশ্য পাল্টা কোনও মন্তব্য করেননি।
তবে বিধানসভায় সরকারি পক্ষের মুখ্য সচেতক শোভনদেববাবু যে দলনেত্রীর সিদ্ধান্তে ‘ক্ষুণ্ণ’, তা তিনি গোপন করেননি। বৈঠকে মমতা ওই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পর ‘মর্মাহত’ শোভনদেববাবু দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁর ‘অনুযোগে’র কথা সরাসরিই জানিয়েছেন বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। এমনকী, মমতা তাঁকে মন্ত্রিত্বে নিয়ে আসার কথা বললেও শোভনদেববাবু তা প্রত্যাখ্যান করেন। উল্টে তিনি জানান, মমতা চাইলে রাজ্য বিধানসভার সরকারি মুখ্য সচেতকের পদটিও তাঁর কাছ থেকে নিয়ে নিতে পারেন। তাতেও তাঁর কোনও আপত্তি নেই। প্রকাশ্যে বর্যীয়ান বিধায়ক শোভনদেববাবু অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রীর সঙ্গে কথোপকথন নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। প্রাথমিক ভাবে তিনি বলেছেন, “আমি দলের অনুগত সৈনিক ছিলাম। সেই হিসেবেই কাজ করব।” তবে পাশাপাশিই তাঁর বক্তব্য, “এটা গভীর ষড়যন্ত্র। এতে তৃণমূলের ক্ষতি হবে।” খানিকটা অভিমানের সুরেই তিনি বলেছেন, “হতে পারে সংগঠনের কাজে আমার যোগ্যতার অভাব রয়েছে। হতে পারে দলের প্রতি আমার আনুগত্যের অভাব হয়েছে।”
তৃণমূল সূত্রের খবর, শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বে ওই রদবদল মূলত গোষ্ঠীলড়াই এড়াতেই। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বিভিন্ন পর্যায়ে খবর আসছিল যে, একই প্রতিষ্ঠানে তৃণমূলেরই দু’টি সংগঠন সমান্তরাল ভাবে কাজ করছে। সংগঠনের রাজ্য সভানেত্রী দোলা সেনের সঙ্গেও শোভনবাবুর নিয়মিত ‘সংঘাত’ হচ্ছিল। কিন্তু তৃণমূলের একাংশের মতে, শোভনবাবু তৃণমূলের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে মমতার সঙ্গে রয়েছেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর প্রতি দলনেত্রী আরও ‘সহানুভূতিশীল’ হতে পারতেন। বৈঠকে উপস্থিত এক নেতার কথায়, “শোভনদার বয়স এবং অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্তের কথাটা সর্বসমক্ষে না-বলে তাঁকে একান্তেও বলা যেত।”
পরে রদবদল প্রসঙ্গে পার্থবাবু বলেন, “তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আরও মজবুত করতেই সুব্রতদা, পূর্ণেন্দুবাবুর মতো অভিজ্ঞ শ্রমিক নেতাদের নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।” তবে দলের একাংশ জানাচ্ছেন, দোলা সেনের নেতৃত্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সংগঠন চলছে। আবার দীর্ঘদিন শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে রয়েছেন বলে শোভনদেববাবুর অনুগামীরাও আলাদা সংগঠন চালাচ্ছেন। ফলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব হচ্ছে। পার্থবাবু যেমন সরাসরিই বলেছেন, “এখন থেকে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে তৃণমূলের একটিই শ্রমিক সংগঠন থাকবে।”
এ দিনের বৈঠকে দুই শোভন, মন্ত্রী সুব্রতবাবু, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, পূর্ণেন্দুবাবু, দোলা ছাড়াও ছিলেন দলের আইনজীবী-সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দক্ষিণ কলকাতার সাংসদ সুব্রত বক্সী। প্রসঙ্গত, মেয়রের কাজে ‘অসন্তুষ্ট’ মমতা মঙ্গলবারেই কলকাতা পুরসভার দলীয় কাউন্সিলরদের নিয়ে বৈঠক করার জন্য সুব্রতবাবুকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। যে বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল সাংসদ এলাকা উন্নয়ন তহবিলের টাকায় কলকাতার উন্নয়ন। ওই বৈঠকে মেয়র নিজেও হাজির ছিলেন। কিন্তু একই সঙ্গে সেই কাউন্সিলররাও ছিলেন, যাঁরা দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রের আওতায় পড়েন না।
দলের এক কাউন্সিলরের কথায়, “মেয়রকে চাপে রাখতেই সুব্রত বক্সীকে দিয়ে ওই বৈঠক করিয়েছেন নেত্রী।” মমতার ‘আস্থাভাজন’ সুব্রতবাবু অবশ্য বৈঠকে বলেন, “আমি সাংসদ এলাকা উন্নয়ন তহবিলের অর্থ ব্যয় নিয়ে আলোচনা করতে এসেছি। কারণ, ওই কাজের ব্যাপারে কলকাতা পুরসভাই নোডাল এজেন্সি। মেয়রই এই বৈঠক ডেকেছেন। উত্তর কলকাতার সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় আসতে পারেননি। উনি তিন বারের সাংসদ। ফলে অভিজ্ঞতাও বেশি। আমি নতুন। তাই কথা বলে নিতে চাই।” সুব্রতবাবু যতই ‘লঘু’ করে বিষয়টি দেখানোর চেষ্টা করুন না কেন, তৃণমূলের অন্দরে কিন্তু জল্পনা শুরু হয়েছে। বিশেষত, তিনি শুধু দলীয় কাউন্সিলরদের নিয়েই বৈঠক করায়। দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা এলাকায় বাম কাউন্সিলরদের কেন বৈঠকে ডাকা হল না? সুব্রতবাবু বলেন, “আগে নিজেদের দলের বিষয়টি গুছিয়ে নিই। তার পর অন্য দলের কাউন্সিলরদের সঙ্গেও কথা বলব।”
তার পর দিনই মহাকরণে দলের অন্য প্রথম সারির নেতাদের উপস্থিতিতেই মেয়রকে মুখ্যমন্ত্রীর ‘ধমক’ তৃণমূলের অন্দরের জল্পনা আরও উস্কে দিয়েছে। এক দিকে মেয়র শোভনকে ‘বার্তা’ দিয়ে সাংসদ সুব্রতবাবুকে সামনে আনা। অন্য দিকে, শ্রমিকনেতা শোভনদেবকে সরিয়ে মন্ত্রী সুব্রতবাবুকে দায়িত্ব দেওয়া তৃণমূলের এক নেতার প্রশ্ন, “দুই শোভনের বদলি দুই সুব্রত নাকি?” |
|
|
|
|
|