পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন, তবে প্রাধান্য পাচ্ছে উত্তরপ্রদেশ। স্বাভাবিক। কুড়ি কোটি জনসংখ্যার রাজ্য, পৃথক রাষ্ট্র হলে জনসংখ্যার হিসেবে বিশ্বের পঞ্চম রাষ্ট্রের মর্যাদা পেত এই ভূখণ্ড। কিন্তু এ বারের বিধানসভা নির্বাচন ওই রাজ্যে সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ। ২০০৭-এর নির্বাচন ছিল নিছকই মায়াবতী বনাম মুলায়মের লড়াই। এ বার তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাহুল বনাম নিতিন বনাম মমতা বনাম টিম অণ্ণা...
আসলে ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনের ফল বেশ কিছু হিসেব পাল্টে দিয়েছে। বিশেষত, প্রায় দশ শতাংশ ভোট বাড়িয়ে চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি ঘটিয়েছে জাতীয় কংগ্রেস। এমনিতে ‘পিছড়ে বর্গ’র সমর্থনের জন্য প্রতিযোগিতা নিরন্তর জারি আছে। বিজেপি বাদে বাকি সব দলেরই মূল সামাজিক পুঁজি হল ‘পিছড়ে বর্গ’ভুক্ত মানুষের আবেগ। তার সঙ্গে যুক্ত থেকেছে সংখ্যালঘু মত। কিন্তু মায়াবতী তাঁর উত্থানপর্বে এই সামাজিক বাধ্যবাধকতাকে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অভিমুখ দেন। মুসলিম-যাদব (এম-ওয়াই ফ্যাক্টর) যোগসূত্রে মুলায়ম তাঁর সাইকেল যাত্রা শুরু করলেও কোনও দিনই মায়াবতীর মতো তিনি নির্দিষ্ট শত্রু চিহ্নিত করতে পারেননি। ফলে ‘পিছড়ে বর্গ’-এর ত্রাতা হলেও ‘মসিহা’ হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। গড়ে ওঠেনি তাঁর নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বক্তব্য। যদিও মুসলিম জনমানসে মুলায়ম আস্থাভাজন। তিনি কখনও বিজেপি সঙ্গ করেননি।
অন্য দিকে, গুরু কাঁসিরামের মতো ‘মনুবাদী’ দলগুলোর বিরোধিতাই শুধু নয়, এক তীব্র উচ্চবর্ণবিরোধী ঘৃণাভাষ্য নির্মাণ করে মায়াবতী ক্রমাগত সামাজিক অভিযোজন ঘটিয়ে গেছেন। তিনি স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘তিলক, তরাজু অউর তলোয়ার / ইনকো মারো জুতা চার।’ বহিষ্করণের এই রাজনীতি প্রাথমিক দৌড়ে এগিয়ে রাখলেও তাঁর পায়ের তলার মাটি শক্ত করেনি। |
মায়াবতীর আক্রমণের তীব্রতা তাঁকে অবশ্যই দলিত মসিহা হিসেবে প্রাথমিক ভাবে চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু কালক্রমে তিনি বুঝলেন যে, এক দিকে যেমন দলিত ও মুসলিমদের স্বার্থ একাকার নয়, বরঞ্চ কিছুটা ব্যস্তানুপাতিক, অন্য দিকে উচ্চবর্ণের ভোট পুরোটাই কংগ্রেস বা বিজেপির দিকে যেতে দেওয়া যায় না। দলিত স্বার্থে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ায় এবং কখনও সখনও বিজেপি সঙ্গ করায় মায়াবতী মুসলিমদের একত্রিত সমর্থন পাননি কোনও দিনই। উত্তরপ্রদেশে মুলায়মের সংখ্যালঘু সমর্থন অটুট। ২০০৭ নির্বাচনের প্রাক্কালে তাই দলিত নেত্রী ‘সর্বজনহিতে’ গড়ে তুললেন একটি রামধনু সামাজিক জোট। সচেতন ভাবেই অস্পষ্ট রাখলেন তাঁর প্রাথমিক অবস্থান। যেমন ২০০৯ লোকসভা ও ’১১ বিধানসভা ভোটের প্রাক্কালে মমতাদেবী করেছিলেন এ রাজ্যে।
মায়াবতীর পরিবর্তিত অবস্থান ২০০৭-এ সমস্ত জল্পনার অবসান ঘটিয়ে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর তখ্তে বসায়। একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় বহুজন সমাজ পার্টি। কিন্তু ২০০৯-এর লোকসভায় সেই অবস্থান ধরে রাখতে ব্যর্থ হলেন মায়াবতী। বোঝা গেল সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেসের ভোট একত্রিত হলে বিপদে পড়বেন তিনি। মুলায়মের সামাজিক রসায়ন অপরিবর্তিত থাকলেও মায়াবতী হারিয়েছেন তাঁর ‘দলিত ভোট’-এর অনেকাংশ। যে ‘উচ্চবর্ণবিদ্বেষ’ এই ভোট একত্রিত করেছিল তার শৈথিল্যই সহায় হল কংগ্রেসের। এমনিতে উচ্চবর্ণ ভোটের কিয়দংশ কংগ্রেসের সঙ্গে আছে। সেই সমর্থন অটুট রাখতে রীতা বহুগুণা যোশির মতো শহুরে নেত্রীকে আক্রমণাত্মক অবস্থানে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে মায়াবতীর বিপ্রতীপে। অন্য দিকে রাহুল গাঁধী। দলিত বস্তিতে রাত কাটিয়ে নয়া সমীকরণের জন্মদাতা তিনি। ভাট্টা পারসলে কিংবা আলিগড়ে কৃষক মহা পঞ্চায়েতে চাষির অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে ঘুম কেড়েছেন মায়াবতীর। আশ্চর্য হই না যখন দেখি, মায়াবতী নির্দিষ্ট ভাবে রাহুলকে আক্রমণ করে যাচ্ছেন। দলিতদের পই পই করে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে রাহুলের ‘দলিত প্রীতি’ একান্তই লোকদেখানো। এমনও বলছেন যে দলিত বস্তি থেকে বেরিয়ে রাহুল নাকি বিশেষ এক প্রকার সাবান দিয়ে স্নান করেন। বোঝাই যাচ্ছে, নেত্রী কিছুটা নার্ভাস, তাঁর পুরনো প্রকরণগুলি ব্যবহার করছেন।
অবশ্য করবেনই বা কী? দুর্নীতিতে জেরবার মায়াবতী প্রশাসনটাই ঠিক মতো চালাতে পারেননি। তাঁর নিজের ও হাতির মূর্তি স্থাপন এবং তা ঢেকে ফেলার গ্লানি না হয় উহ্যই থাক। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের বহু কোটি টাকার কেলেঙ্কারি তো আর কাপড় দিয়ে ঢাকা যাচ্ছে না। বাবু সিংহ কুশওয়াহা বহিষ্কৃত। কাঁসিরামের স্নেহধন্য এই নেতা কংগ্রেসের নাগাল না পেয়ে বি জে পিকে আলতো করে ছুঁয়ে আছেন। সর্বত্র ঘুরে ঘুরে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছেন মায়াবতীকে। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত প্রাক্তন মন্ত্রী নিজেই ন্যায়পরায়ণতার পরাকাষ্ঠা হওয়ার চেষ্টা করছেন, এমন সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু তাতে তাঁর বা মায়াবতীর, কারও বিপদই কমছে না। ২৩ জানুয়ারি অপমৃত্যু হয়েছে স্বাস্থ্য মিশনের অন্যতম প্রোজেক্ট অফিসার সুনীল বর্মার। এই নিয়ে তদন্ত চলাকালীন চতুর্থ অপমৃত্যু। সি বি আই তদন্তে এই অপমৃত্যুর অন্তর্ভুক্তির দাবিতে সরব হয়েছেন বিরোধীরা। ভোটের বাজার আরও গরম হয়েছে।
এত কিছুর মধ্যে মোদ্দা কথাটা বলে ফেলেছেন বি জে পি সভাপতি নিতিন গডকড়ী। তাঁর মতে, এই বিধানসভা নির্বাচন আসলে ২০১৪ লোকসভা ভোটের ‘সেমিফাইনাল’। প্রসঙ্গত, বি জে পি যতই সমর্থনের আশা করুক, ‘টিম অণ্ণা’ এ যাত্রা কোনও দলের সঙ্গেই যাবেন না বলেছেন। তাঁরা টানা এক মাস জনগণকে বোঝাবেন জন লোকপালের দাবির কথা মাথায় রেখে ভোট দিতে। টিম অণ্ণার সঙ্গে থাকলে কুশওয়াহাকে ভোটের কাজে ব্যবহার করা যায় না। টিম অণ্ণাও বি জে পি-র ভোটভাগ্যের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে অপদস্থ হতে চাইছেন না; যদি চতুর্থ স্থানাধিকারী হয় বি জে পি তবে তার দায়িত্ব কেন নেবেন কেজরিওয়াল বা কিরণ বেদী?
কিন্তু গডকড়ীর কথা ফেলনা নয়। যদি মুলায়মকে সরকার গড়তে কংগ্রেসের ওপর নির্ভর করতেই হয়, তবে অতি উচ্চাশাপরায়ণ কংগ্রেস কেন্দ্রে তৃণমূল-নির্ভরতা কমাতে চাইবে। বামেদের সঙ্গে টক্কর দিতে মমতাদেবী প্রতিটি প্রশ্নে বামসুলভ অবস্থান নিচ্ছেন। মুলায়ম সে বান্দা নন। বামেরা তাঁর প্রতিপক্ষও না। অতএব কংগ্রেস-মুলায়ম নিকটবর্তী হলে এ রাজ্যে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটনাট্য আরও তীব্র হবে।
উল্টো ভাবে যদি দেখি, কেন্দ্রে কংগ্রেসকে সরকার বাঁচাতে তৃণমূলের ওপর নির্ভর করতে হলে ২০১৪-র লোকসভায় বামপন্থীরা এ রাজ্যে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকার বিরোধী আবেগের সুযোগ কাজে লাগাবেন। কিন্তু তৃণমূল যদি কেন্দ্রীয় সরকারের বাইরে থাকতে পারে, তবে ওই কেন্দ্রবিরোধী আবেগের ভাগীদার মমতাদেবীও হতে পারবেন। উত্তরপ্রদেশে একা বা বি জে পি-র হাত ধরে মায়াবতীর পুনরভিষেক জোট রাজনীতির অঙ্কে কোনও জটিলতা আনতে পারবে না। বরঞ্চ মুলায়মের আগমনই ২০১৪-র ‘ফাইনাল’কে জমিয়ে দেবে।
|
বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক |