|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
পুরো পাঁচ বছর টিকে থাকার রেকর্ড? |
পাকিস্তানে ৬৫ বছরে কোনও নির্বাচিত সরকার পারেনি। প্রধানমন্ত্রী গিলানি পারবেন?
এক দিকে সেনা ছাউনি, অন্য দিকে সুপ্রিম কোর্ট, দুইয়ের চাপ সামলে? আর এক বছর বাকি।
পাকিস্তান রাজনীতির
গতি ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করেছেন
সেমন্তী ঘোষ |
নিজের সংকট নিয়ে নিজেই পরিহাস করতে পারেন, এমন রাজনীতিকের খোঁজ সহসা মেলে না! দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি সেই বিরল প্রজাতিভুক্ত। অন্তহীন অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে: তারই মধ্যে সাম্প্রতিক এই আত্ম-পরিহাস তাঁর বেশ অন্য রকম একটা ছবি দেখাল। কথাটা উঠেছিল যখন তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়, সীমান্তের ও পারে আর-এক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ মশাই বলেছেন, গিলানির মধ্যে আছে শান্তির বার্তা: ‘ম্যান অব পিস’। শুনেই গিলানির সহাস্য উত্তর, পাক রাজনীতির কথা মাথায় রাখলে কিন্তু তাঁর মধ্যে মিলবে সংকটেরই বার্তা: ‘ম্যান অব ক্রাইসিস’!
দুটো কথাই ঠিক। এবং দুটো ‘ঠিক’-এর মধ্যে খানিকটা সংযোগও আছে। অন্তত শেষ দুটি ভারত-পাকিস্তান সরকারি মোলাকাতে স্পষ্ট যে গিলানি চান, দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব না হোক শান্তি থাকুক, শান্তি না হোক স্বস্তি থাকুক। চলতি সপ্তাহে কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এমনও বলেছেন যে, ভারতের সঙ্গে আরও একটা যুদ্ধ লড়ার প্রশ্নই ওঠে না। চার-চার বার হয়ে গিয়েছে, ১৯৪৭-৪৮, ১৯৬৫, ১৯৭১, ১৯৯৯, পাঁচ বার আর নয়। একুশ শতকে দুই পরমাণু-শক্তিধর বিশ্বশক্তিকে অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে, আলোচনা, কূটনীতি দিয়ে সমাধানে পৌঁছতে হবে। কেউ বলতেই পারেন, ও সব রাজনৈতিক বোলচাল, রেটরিক। তা, এইটুকু রেটরিক-ই বা ক’জন পাক নেতা আউড়ান, তাও আবার খাস ইসলামাবাদে দাঁড়িয়ে? আর এও তো ঠিক যে, ক্ষমতায় আসার পর থেকে যে গিলানির পিপিপি (পাকিস্তান পিপলস পার্টি) সরকারের একটি দিনও সংকটহীন কাটেনি, তার আমলেও কিন্তু ক্রমে ভারতের সঙ্গে খানিক সহজ সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব হয়েছে! পাক পার্লামেন্ট নভেম্বর মাসে ভারতকে ‘মোস্ট ফেভারড্ নেশন’ (এম-এফ-এন) স্টেটাস দিয়েছে। ২০১২-র জানুয়ারিতে একটি ভারতীয় প্রতিনিধিদল পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। দলের দুই সদস্য প্রাক্তন মন্ত্রী মণিশংকর আইয়ার এবং যশোবন্ত সিংহ দু’জন দুই বিপরীত রাজনৈতিক শিবিরের দু’জনেই বললেন, এ বার যে সদর্থক মনোভাব তাঁরা পেলেন, ২০১১-র জানুয়ারিতে সেটা ভাবা যেত না।
কিন্তু পাকিস্তানি রাজনৈতিক সমাজের একটা বড় অংশের এ সব পছন্দ নয়। মুশকিল হল, এই বিদ্বিষ্ট বড় অংশটির মধ্যেই রয়েছে পাকিস্তানি সামরিক মহল: যুদ্ধ না হলেও যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাবটা জিইয়ে রাখাটাই যাদের কর্ম, ধর্মও বটে। সেই পুরনো কথাটা আর বলার দরকার নেই যে, ভারতবিরোধিতার প্রয়োজনেই ধর্মীয় মৌলবাদকে, এবং সেই সূত্রে, জঙ্গিগোষ্ঠীগুলিকে পোষণ করে চলে পাক সামরিক বাহিনী। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী গিলানি যে সামরিক হর্তাকর্তাদের না-পসন্দ্, সেটা আশ্চর্য নয়। |
|
যুযুধান প্রতিপক্ষ। প্রধানমন্ত্রী গিলানি এবং মেজর জেনারেল কিয়ানি, ইসলামাবাদ, জানুয়ারি। ছবি: এ এফ পি |
অবশ্য ভারত-নীতির প্রশ্নেই গিলানির প্রতি পাক সামরিক মহলের এই বিদ্বেষ, এটা ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। ব্যাপারটা জটিল। ২০০৮ সালে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে শরিকি সরকার তৈরি করে ক্ষমতায় আসে পিপিপি, মার্চে প্রধানমন্ত্রী হন গিলানি। ২০১৩-র মার্চে পরের নির্বাচন হওয়ার কথা। সেই অবধি সরকার চালিয়ে যদি নির্বাচনে পৌঁছনো সম্ভব হয়, তা হলে পঁয়ষট্টি বছরের পাকিস্তানে একটা রেকর্ড তৈরি হবে: গিলানির সরকারই হবে পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচিত সরকার, যার পক্ষে সফল ভাবে ‘টার্ম’ শেষ করা সম্ভব হল। এই রেকর্ডের যতই কাছাকাছি পৌঁছচ্ছেন গিলানি, ততই তাঁর উপর সেনা-মহলের চাপ বাড়ছে। গণতন্ত্রের সঙ্গে সামরিক প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক তো কখনওই সহযোগিতার হতে পারে না, পারে কি? গিলানির বর্তমান সংকটটা বোঝার জন্য গণতন্ত্র-সমরতন্ত্রের সেই মৌলিক বিরুদ্ধতাটা মনে রাখা জরুরি।
গিলানি নিজেও সমানে চটিয়ে যাচ্ছে সেনা-মহলকে। ৯ জানুয়ারি চিনা প্রচারমাধ্যমে অনলাইন ইন্টারভিউ-তে তাঁর অভিযোগ: পাক সেনা-প্রতিষ্ঠান ও গোয়েন্দা বিভাগ আই এস আই অসাংবিধানিক কাজ করছে, ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে সরকারকে অপদস্থ করার চেষ্টা করছে। ঘটনাচক্রে ঠিক তখনই উচ্চতম পাক সেনাকর্তা জেনারেল আশফাক কিয়ানি চিন সফরে গিয়েছেন। ১১ জানুয়ারি প্রবল হুঁশিয়ারি শোনা গেল কিয়ানির মুখে: গিলানি যেন সংযত থাকেন, নতুবা ভয়ঙ্কর দুর্দৈব অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য! কিন্তু গিলানি হঠাৎ এই সময়টা বেছে নিলেন কেন তোপ দাগার জন্য? যখন তাঁরই রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি বিদেশ-সফররত, তখন সেই দেশেরই প্রচারমাধ্যমে সেই ব্যক্তি বিষয়ে বিষোদ্গার কেন? গিলানি তো জানেনই যে আমেরিকার মতো চিন প্রকাশ্যত পাক রাজনীতিতে মাথা গলাতে চায় না, প্রচ্ছন্ন দড়ি-টানাটানিতেই তার আগ্রহ; তবে? আসলে গিলানি জানেন যে, বেজিং-এর এই প্রচ্ছন্ন সমীকরণ-নির্মাণে জেনারেল কিয়ানির একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, তাই তাঁকে অপদস্থ করার সেটাই ছিল মহাসুযোগ। বৃথা যায়নি কিয়ানির হুঙ্কার। পর পর নানা ঘটনায় গিলানির সংকট বেড়ে চলেছে উপর্যুপরি। আপাতত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করার জন্য আদালত অবমাননার দায়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি হাজিরা দেওয়ার জন্য তাঁর কাছে শমন পৌঁছেছে। বাস্তবিক, এই মুহূর্তে জেনারেল কিয়ানি ও প্রধানমন্ত্রী গিলানির পাশাপাশি ছবি দেখলে ভয়-ভয় লাগে, ছবি থেকেই বিদ্যুৎ-তরঙ্গ ছিটকে বেরোবে না তো!
|
সমস্যার নাম জারদারি |
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অবশ্য সত্যিই গিলানি মানেননি। প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ। তার মধ্যে কোটি কোটি ডলারের সরকারি অর্থ নয়ছয়ের কাণ্ডও রয়েছে। সরকারের কাছে কোর্টের নির্দেশ যায়, জারদারির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করতে, বিশেষত সুইৎজারল্যান্ড সরকারকে অনুরোধ করতে যাতে সুইস আদালতে জারদারির বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়। গিলানি রাজি হননি। তাঁর বক্তব্য: রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে জারদারির পদমর্যাদাগত সুরক্ষা প্রাপ্য, সুতরাং তদন্তের আদেশ দেওয়া যাবে না।
পাক রাজনীতির একটি মহল তাই মনে করে, সরকারের আসল সমস্যা প্রধানমন্ত্রী নন, প্রেসিডেন্ট। জারদারির জন্যই সরকারের আজ এমন হেনস্থা। প্রসঙ্গত, গিলানির সঙ্গে জারদারির সম্পর্ক প্রথমাবধিই অসৌহার্দ্যপূর্ণ, প্রথম থেকেই জারদারির প্রেসিডেন্ট-পদ লাভের প্রধান বাধা তাঁর বিরুদ্ধে ঝুলন্ত দুর্নীতি-মামলা। প্রধান বিচারপতি ইফতিকার মহম্মদ চৌধুরির সঙ্গে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মুশারফের তীব্র দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে ২০০৭-এর নভেম্বরে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করে সব বিচারককে মুশারফ সটান বরখাস্ত করেন। সেই অবকাশেই রাজনীতির কেন্দ্রে ফিরে আসেন জারদারি। এ দিকে ২০০৯-এর মার্চে আইনজীবীদের ‘লং মার্চ’ আন্দোলনের অভিঘাতে আবার জাস্টিস চৌধুরিকে ফেরাতে বাধ্য হন গিলানি। বিচারবিভাগের ক্ষমতাও ফেরে। জারদারিও আবার অভিযোগ-সাগরে ভাসতে শুরু করেন।
এই ঘটনা থেকে কিন্তু একটা বড় সামাজিক-রাজনৈতিক ছবির আভাস মেলে। সেটা সদর্থক পরিবর্তনের ছবি। সেই ছবি বলে যে, পাক সেনা-গোয়েন্দা-আঁতাত তাদের দখল কায়েম করতে অতি-উৎসাহী বটে, কিন্তু পাশাপাশি কিছু অন্য শক্তিরও স্ফুরণ ঘটছে। এক অর্থে তাকে বলা চলে নাগরিক শক্তি, নাগরিক সমাজ। বিচারবিভাগের কর্তারা তার অগ্রগণ্য সদস্য। ঘরে-বাইরে দুর্নীতিগ্রস্ত, প্রবল অকর্মণ্য, সামাজিক-অর্থনৈতিক সংস্কারের চৌকাঠ-না-মাড়ানো নেতা-মন্ত্রীদের ছেড়ে কথা-না-বলার এই-যে জোরদার প্রয়াস তার পিছনে যেমন এক দিকে জারদারি-গিলানির অ-শুভাকাঙ্ক্ষী সামরিক কর্তারা রয়েছেন, অন্য দিকে তেমনই রয়েছে সমাজের বহু অংশের হতাশা ও অধৈর্য। ২০০৯ সালে আইনজীবীদের সফল আন্দোলন থেকেই হয়তো এই পরিবর্তনের শুরু। তাঁরা বুঝতে পারছেন, এই রাজনীতিকদের দিয়ে হবে না, এঁদের তাঁরা চান না। কিন্তু এঁদের বিকল্প-ই বা কোথায়, তাও তাঁরা জানেন না। আশঙ্কা হয়, অসামরিক সমাজের দৃঢ়তার এই আভাসটুকু অচিরেই সামরিক-জাঁতার পেষণে বেমালুম হারিয়ে যাবে, কেবল সময়ের অপেক্ষা।
|
এবং রাওয়ালপিন্ডি |
সামরিক জাঁতাকল সজোরে ঘুরছে, চার দিকেই। এই মুহূর্তে গিলানি সরকার অন্য যে দ্বিতীয় সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে, তারও সঙ্গে এই জাঁতাকলের যোগ। অক্টোবরে মার্কিন কংগ্রেসে কেরি-লুগার-বারম্যান আইন (KLB) পাশ হয়, যাতে বলা হয় ইসলামাবাদকে ওয়াশিংটন ৭৫০ কোটি ডলার সহায়তা দেবে, যদি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য এই যদি-টি ইসলামাবাদ অসামরিক সরকার দ্বারা শাসিত হয়, এবং সামরিক শক্তির উপর যদি অসামরিক সরকারের দৃষ্টিগ্রাহ্য নিয়ন্ত্রণ থাকে। পাকিস্তানে এই কে-এল-বি রীতিমত বিস্ফোরক পরিস্থিতি তৈরি করে। গিলানি স্বভাবতই সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানান। এ দিকে মার্কিন-প্রবাসী পাকিস্তানি ব্যবসায়ী মনসুর আইজাজ অভিযোগ তোলেন যে, প্রাক্তন পাক রাষ্ট্রদূত হুসেন হাক্কানি নাকি নিজে প্রত্যক্ষ ভাবে এই বিল তৈরির জন্য দায়ী: একটি অতি-বিতর্কিত ‘মেমো’ আইজাজের হাতে প্রেসিডেন্ট ওবামার সহকর্মীদের হাতে পাঠিয়ে তিনি সামরিক সরকারের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাইছিলেন! কার কাছ থেকে এল এই মেমো? কানাঘুষোর আঙুল কিন্তু প্রেসিডেন্ট জারদারির দিকেই!
কতটা সাজানো, কতটা বাড়ানো, এই সব তর্কের ঊর্ধ্বে উঠে ‘মেমোগেট কেলেঙ্কারি’ একটি উদ্দেশ্য নিশ্চিত ভাবে সিদ্ধ করেছে: গিলানি সরকার যে সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে লেগে নেই, সেটা প্রমাণ করার সমস্ত দায় সরকারের কাঁধেই এনে ফেলেছে। এবং, পাক সার্বভৌমত্বের মহা-সংবেদনশীল প্রশ্নটিকে আবার জনসমাজের সামনে নাচাতে শুরু করেছে: গিলানির সরকার যে দেশের সার্বভৌমত্ব আমেরিকার কাছে ‘বিকিয়ে’ দিচ্ছে না, তা প্রমাণের দায়ও সরকারের উপর চেপেছে। এই সরকারের যেটুকু যা স্বাধীনচেতা অসামরিক কর্তৃত্ব, তাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই যে এই পুরো সংকটের উপস্থাপনা, তা নিয়ে সংশয়ের জায়গা কোথায়! আপাতত তাই আদালতের রায়ের উপরেই নির্ভর করছে এই সরকারের ভাগ্য। যদি প্রধানমন্ত্রীকে আদালত অবমাননার দায়ে বরখাস্ত করা হয়, তবে এক রকমের সাংবিধানিক সংকট। যদি তিনি এর মধ্যে পদত্যাগ করেন, তবে আর এক রকমের সংকট। যদি স্থির হয় যে, নির্বাচন এ বছরই এগিয়ে আনা হবে, তাতেও আশার আলো কম। কেননা নির্বাচনে লড়ার উপযোগী অবস্থায় প্রায় কোনও দলই নেই এখন, ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা উঠবে তুঙ্গে। সামরিক শাসন জারি হওয়ার আশঙ্কাও যে নেই তা নয়, তবে সম্ভাব্যতার তালিকায় সেটাই সবচেয়ে নীচে। হাজার হোক, শতকটা একুশ। হাজার হোক, আমেরিকার ডলার-প্রবাহটা চাই-ই চাই। রাওয়ালপিন্ডির পক্ষে সোজা হেঁটে এসে ইসলামাবাদ নিয়ে নেওয়া আজ তাই সত্যিই কঠিন। তার এখন দরকার আড়াল দিয়ে লুকিয়ে শাসন। সেই ‘আড়াল’টা কেমন দাঁড়াবে, ফেব্রুয়ারি মাসটা কাটলে হয়তো কিছু আন্দাজ মিলতে পারে! |
|
|
|
|
|