মাত্র সাড়ে এগারো মাস পূর্বের কথা। দেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা, এবং তাহার পর সাধারণ বাজেট পেশ করিয়া অর্থমন্ত্রী জানাইলেন, ২০১১-১২ অর্থবর্ষে মোট জাতীয় উৎপাদনের বৃদ্ধির হার প্রায় নয় শতাংশে পৌঁছাইবার সম্ভাবনা। কেহ সেই আশাবাদকে ভিত্তিহীন ভাবেন নাই, কারণ ২০১০-১১ অর্থবর্ষের ৮.৪ শতাংশ বৃদ্ধির হারের অভিজ্ঞানটি তখন অর্থমন্ত্রীর হাতে, ভারত তখনও বিশ্ব-অর্থনীতির ‘বিস্ময় বালক’। কেহ অনুমান করিতে পারে নাই, বর্তমান অর্থবর্ষে বৃদ্ধির হার সাত শতাংশের নীচে নামিয়া যাওয়া প্রায় অনিবার্য হইবে। সম্প্রতি সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিকাল অর্গানাইজেশন অগ্রিম অনুমান জানাইল, এই অর্থবর্ষে বৃদ্ধির হার ৬.৯ শতাংশ হওয়ার সম্ভাবনা। গত এক বৎসর যাবৎ ক্রমেই সংকেত মিলিতেছিল যে ভারতীয় অর্থনীতির গতিভঙ্গ হইতেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানাইয়াছে, তাহারা ৬.৮ শতাংশ বৃদ্ধির হার অনুমান করিতেছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের অনুমানও ইহারই কাছাকাছি। গোটা অর্থবর্ষ ভারতীয় অর্থনীতি যে রক্তাল্পতার প্রমাণ পেশ করিয়াছে, তাহাতে এই পরিণতি অমোঘ ছিল। কিন্তু ভুলিলে চলিবে না, ২০০৭-০৮ অর্থবর্ষে, যখন অর্থনৈতিক সঙ্কটে গোটা দুনিয়া কম্পমান, ভারতে উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৭ শতাংশ। বর্তমান হারের তুলনায় সামান্যই কম।
তবে একটি আশা প্রায় সর্বজনীন। ভারতীয় অর্থনীতির যে তলানিতে পৌঁছাইবার ছিল, সেখানে পৌঁছানো সম্পূর্ণ হইয়াছে, এখন ঘুরিয়া দাঁড়াইবার পালা। আশার ভিত্তি বিশ্ব অর্থনীতি। ইউরোপের সঙ্কট, ধীরে ধীরে হইলেও, ক্রমে কাটিতেছে; মার্কিন অর্থনীতিও ঘুরিয়া দাঁড়াইতেছে। ফলে, বাজারে অনিশ্চয়তা ক্রমে কমিবে। ভারতের অর্থনীতিও সেই টানে ঘুরিয়া দাঁড়াইবে। এই যুক্তিটি লইয়া কিছু সমস্যা আছে। তাহা বুঝিতে গেলে ভারতীয় অর্থনীতির গতিভঙ্গের কারণটি ভাঙিয়া দেখা প্রয়োজন। ভারতে মূলধন গঠনের হার গত বৎসরের তুলনায় প্রায় দুই শতাংশ কমিয়াছে। আয়বৃদ্ধির হারের ক্ষেত্রে মূলধন গঠনের অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রহিয়াছে। অন্য দিকে, খনন ক্ষেত্রে উৎপাদন সরাসরি হ্রাস পাইয়াছে। শিল্প উৎপাদনের হার আশাপ্রদ নহে, নির্মাণ ক্ষেত্রেও বৃদ্ধির হার গত বৎসরের তুলনায় অনেকখানি কমিয়াছে। অর্থাৎ, প্রধানত যে ক্ষেত্রগুলির উপর অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের হার নির্ভর করিয়া থাকে, সেগুলি সঙ্কটে। ফলে, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি যদি উন্নত হয়ও, তাহার সুফল ভারত কুড়াইতে পারিবে কি? অর্থনীতির এমন নাজেহাল অবস্থার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের দায় অনেকখানি। গত এক বৎসরে বিভিন্ন সঙ্কটে সরকার এমনই জর্জরিত থাকিয়াছে যে অর্থনীতির যুক্তি-তর্কের দিকে নজর দিতে সময় পায় নাই। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দায়ও অস্বীকার করিবার নহে। গত দেড় বৎসর যাবৎ ব্যাঙ্ক তাহার সর্বশক্তি দিয়া মূল্যস্ফীতির মোকাবিলা করিয়াছে। আর্থিক নীতি ক্রমে কঠোর হইতে কঠোরতর হইয়াছে। এখন মূল্যস্ফীতির হার, সাময়িক ভাবে হইলেও, নিয়ন্ত্রণে আসিয়াছে। এখন অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের বৃদ্ধির হারকেই গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়। সরকারের যেহেতু নীতি-পক্ষাঘাত হইয়াছে, ফলে ব্যাঙ্কের দায়িত্ব আরও বেশি। যথার্থ আর্থিক নীতির মাধ্যমে দেশকে বৃদ্ধির উচ্চ কক্ষপথে পৌঁছাইয়া দেওয়াই প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। নচেৎ ঘুরিয়া দাঁড়াইবার আশা দুরাশায় পর্যবসিত হইতে পারে। |