কঙ্কাল-কাণ্ডে অভিযুক্ত পশ্চিম মেদিনীপুরের সি পি আই এম নেতা সুশান্ত ঘোষ ১৮১ দিনের হাজতবাসের পর কেবল জামিন পাইয়াছেন। এখনও আদালত তাঁহাকে নির্দোষ ঘোষণা করে নাই। এমনকী তাঁহার গতিবিধি কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং নিয়মিত থানায় হাজিরা দিবার মতো কড়া নজরদারির শর্তেই তাঁহাকে জামিন দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু তাহাতেই সি পি আই এমের নেতা-কর্মীরা তাঁহাকে প্রবল সংবর্ধনা দিয়াছেন, তাঁহার যাত্রাপথে পুষ্পবৃষ্টি করা হইয়াছে, ‘আমরা করব জয়’ ইত্যাদি সঙ্গীত, শঙ্খধ্বনি, উলুরব ও উচ্চকণ্ঠ স্লোগানে মুখরিত করা হইয়াছে দক্ষিণ কলিকাতার রাজপথ। যেন কোনও জ্যোতির্ময় নায়কের উদার অভ্যুদয়কে বরণ করা হইতেছে। অথচ সুশান্ত ঘোষ অপহরণ, খুন, গণহত্যা ও নিহতদের মাটিতে পুঁতিয়া দেওয়ার মতো নারকীয় সব কাণ্ডে অভিযুক্তদের নেতা। তাঁহার বিরুদ্ধে মামলার নিষ্পত্তি এখনও দূর-অস্ত্। অন্যান্য গণহত্যা ও তাহার প্রমাণ লোপাটের অভিযোগে আরও মামলা অপেক্ষারত। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, উপর্যুপরি নির্বাচনে রাজ্যবাসীর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত সি পি আই এমের নেতৃত্ব কেন এমন এক জনকে বীরের সম্মান দিতে উদ্গ্রীব? ইহাই কি শুদ্ধিকরণ?
সুশান্ত ঘোষ কিংবা লক্ষ্মণ শেঠের মতো দলীয় মনসবদারদের জন্যই নির্বাচনে দলের ভরাডুবি হইয়াছে এবং তাঁহাদের নেতৃত্ব হইতে দূরে সরাইয়া রাখাই দলের পুনরুজ্জীবনের পূর্বশর্ত, এমন ধারণা হইতেই শুদ্ধকরণের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। সেই প্রক্রিয়া কি তবে প্রত্যাহৃত হইতেছে? না কি দলীয় নেতৃত্ব ভাবিতেছেন, শাসক দলের সমর্থিত তথাকথিত ভৈরব বাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য সুশান্ত ঘোষের মতো তথাকথিত হার্মাদ নেতাদেরই এখন প্রয়োজন? অসম্ভব নয়। জেলায় জেলায় দলের বিভিন্ন কমিটির যে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চলিতেছে তাহাতে দেখা যাইতেছে, সর্বত্রই কুখ্যাত, জননিন্দিত, এমনকী অধুনা বিভিন্ন মামলায় ‘ফেরার’ ও এলাকা হইতে পলাতক স্থানীয় নেতারাই সসম্মানে সেই সব কমিটির নেতৃপদে পুনরভিষিক্ত হইতেছেন। এই নেতাদের অনেকেরই নিজের গ্রামে, পাড়ায় বা জেলাতেও পড়িয়া থাকার সাহস নাই। তবু জনসাধারণের ভয়ে ভীত এই নেতা-কর্মীরা ‘দলের সম্পদ’ বলিয়া আখ্যাত হইতেছেন এবং বিভিন্ন দলীয় সম্মেলনে অনুপস্থিত থাকিয়াও কর্মকর্তার ভূমিকায় ফিরিতেছেন। অশুদ্ধ, বিষাক্ত, বেনো জলকে বাহির করিয়া দিবার প্রক্রিয়াটি অর্থাৎ স্থগিত হইয়া গেল? সুশান্ত ঘোষ, লক্ষ্মণ শেঠ, দীপক সরকার, অনিল বসুরাই তবে স্বমহিমায় ফিরিতেছেন? অন্তত সুশান্তবাবুর নাটকীয় ও বহুবিজ্ঞাপিত বরণ-অনুষ্ঠান সেই দিকেই ইঙ্গিত করে। অচিরেই হয়তো তাঁহাকে ‘পূর্ব মেদিনীপুরের লেনিন’ এবং ‘ফেরার’ লক্ষ্মণ শেঠকে ‘পশ্চিম মেদিনীপুরের স্তালিন’ অভিধায় ভূষিত করিয়া এস এফ আইয়ের সাধারণ সম্পাদক আবেগকম্প্র কম্বুকণ্ঠে নূতন কোনও গণসঙ্গীত গাহিয়া উঠিবেন। শুদ্ধকরণ বরাবরই কমিউনিস্ট পার্টিতে অবাঞ্ছিত লোকদের বিতাড়নের পদ্ধতি। প্রায়শ ইহা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধভাবাপন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে বহিষ্কারের হাতিয়ার। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে নীতি বা কর্মসূচিগত মতভেদের কারণে সচরাচর বিশেষ কেহ বিতাড়িত হন না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেনো জল বাহির করিয়া দিতেই ইহার প্রয়োজন হয়। সি পি আই এমের সামনে সুযোগ ছিল বিপর্যয়ের কারণ অন্বেষণ এবং সৎ আত্মসমীক্ষান্তে দলকে জনবিরোধী চেহারা দেওয়া স্থানীয় মনসবদারদের শনাক্ত করিয়া বিতাড়িত করা কিংবা অন্তত তাহাদের ডানা ছাঁটিয়া দেওয়া। দেখা যাইতেছে, সি পি আই এম সেই সুযোগ হাতছাড়া করিতেই চায়। লেনিন বলিয়াছিলেন-- অভ্যাসের শক্তি বড় দুর্মর। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের হত্যাকারীদের দলের সম্পদ গণ্য করার অভ্যাসও সহসা মিলাইবার নয়। সূর্যকান্ত মিশ্রের মতো ওজনদার নেতা যখন সশরীরে সুশান্ত-বরণে হাজির হন, বুঝা যায়, আট মাস আগের সি পি আই এমের সহিত এখনকার সি পি আই এমের কোনও তফাতই নাই। |