দীর্ঘ ৪৮ বছর আগে তদানীন্তন কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে বেরিয়ে যে ৩২ জন নেতা সিপিএম গড়ে তুলেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র জীবিত সদস্য তিনিই। জীবন-সায়াহ্নে পৌঁছে নিজের রাজ্যেই এ বারের সম্মেলনে প্রবল আক্রমণের মুখে পড়লেন সেই ভেলুক্কাকাতু শঙ্করন অচ্যুতানন্দন!
অশীতিপর ভিএস-কে সামনে রেখেই গত বছরের বিধানসভা নির্বাচনে প্রবল লড়াই চালিয়েছিল কেরল সিপিএম। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউডিএফের চেয়ে মাত্র চারটি আসন কম পেয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয় তারা। কিন্তু লোকসভা ভোটের ভরাডুবির পরের দু’বছরের মধ্যে বিধানসভা ভোটে ‘ঘুরে দাঁড়ানো’ যে ভিএসের ‘ভাবমূর্তি’কে সম্বল করেই সম্ভব হয়েছিল, তা মেনে নিয়েছিল কেন্দ্রীয় কমিটিও। কিন্তু এত কিছুর পরেও কেরলের ২০তম রাজ্য সম্মেলনের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদনে কাঠগড়ায় তোলা হল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীকেই! তাঁর বিরুদ্ধে রাজ্য কমিটির মূল অভিযোগ, দলকে অন্ধকারে রেখে ‘নিজের মতো কাজ’ করতে গিয়ে সিপিএমকে জনসমক্ষে ‘হেয়’ করেছেন।
তিরুঅনন্তপুরমে মঙ্গলবার শুরু-হওয়া রাজ্য সম্মেলনে দলের রাজ্য সম্পাদক পিনারাই বিজয়ন যে রিপোর্ট পেশ করেছেন, তার জেরে সিপিএমের অন্দরে আলোড়ন ফের তুঙ্গে। সম্মেলনের প্রথমদু’দিনে প্রতিবেদনের উপরে আলোচনার সময় অধিকাংশ প্রতিনিধিই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং অধুনা বিরোধী দলনেতা ভিএস-কে নিশানা করছেন।
কেরল সিপিএমে বিজয়ন-গোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় রাজ্য সম্পাদকের প্রতিবেদনের বেঁধে দেওয়া সুরেই ‘অর্কেস্ট্রা’ চলবে এটা প্রত্যাশিতই। শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে পলিটব্যুরো থেকে বহিষ্কৃত ভিএস-কে আসন্ন কোঝিকোড় পার্টি কংগ্রেস থেকে ফের পলিটব্যুরোয় ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় কমিটির একাংশ। কিন্তু দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট এবং সীতারাম ইয়েচুরি, বৃন্দা কারাত, এসআর পিল্লাই, কে বরদারাজন-সহ প্রায় অর্ধেক পলিটব্যুরোর উপস্থিতিতে বিজয়নদের প্রতিবেদন এবং তা নিয়ে আলোচনার সুর ভিএসের ভবিষ্যতের রাস্তায় আরও ‘কাঁটা’ বিছিয়ে দেয় কি না, কৌতূহল তৈরি হয়েছে তা নিয়েই।
সিপিএম সূত্রের খবর, রাজ্য সম্মেলনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই ভিএস তাঁর নিজের মতো চলেছেন। দলকে অন্ধকারে রেখে সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মন্ত্রিসভার সতীর্থদের প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন। লাভালিন মামলায় রাজ্য সম্পাদকের নাম (বিজয়ন) জড়িয়ে বিতর্কের সময় সংবাদমাধ্যম প্রতিক্রিয়া চাওয়ার সময় পার্টি নেতৃত্বের পাশে দাঁড়ানোর পরোয়া করেননি’! গত লোকসভা ভোটে এলডিএফের নির্বাচনী সমঝোতা হয়েছিল আব্দুল নাসের মাদানির পিডিপি-র সঙ্গে। সিপিএম কেন পিডিপি-র মতো ‘মৌলবাদী শক্তি’র হাত ধরবে, তা নিয়ে তখন বিতর্ক হয়। সেই প্রসঙ্গও টেনে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পিডিপি-র সঙ্গে সমঝোতা কার্যকর করার জন্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কোনও চেষ্টাই করেননি। বরং, তাঁর প্রয়াস ছিল দলে বিভাজন উস্কে দেওয়ার। যাতে কোনও ভাবেই দলের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি’। নিজের মতো চলার পথ থেকে দলের তরফে বিরত করার চেষ্টা হলেও তিনি তাতে কান দেননি বলেও সমালোচনা হয়েছে প্রতিবেদনে।
ভিএসের পক্ষে আরও ‘বিড়ম্বনা’র বন্দোবস্ত সিপিএম নেতৃত্বই করে দিয়েছেন! তিরুঅনন্তপুরমে কেরল বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে আসান স্কোয়ারে শহিদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং রক্তপতাকা উত্তোলন করে আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্মেলনের সূচনা করার ‘সম্মান’ প্রবীণতম নেতা হিসাবে ভিএস-কেই দিয়েছিলেন কারাট। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী পতাকা তুলে কমিউনিস্টদের সংগ্রামের পক্ষে স্বভাবসিদ্ধ ‘আবেগমথিত’ ভাষণও দেন। যেখানে সংবাদমাধ্যমও ছিল। কিন্তু সম্মেলনের ভিতরে যেতেই সম্পূর্ণ উল্টো ছবি! সেখানে আক্রমণের তির ভিএসের দিকেই। সংখ্যাগুরু বিজয়নপন্থীরা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সরব। তাঁর হয়ে ব্যাট করছেন যাঁরা, তাঁরা সংখ্যালঘু।
এই রাজ্য সম্মেলনেই যিশু খ্রিস্টের ছবি ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক তাড়া করেছে সিপিএমকে। সেই সম্মেলনেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর অভিজ্ঞতা দেখে কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্যের মন্তব্য, “আসলে ক্রুশবিদ্ধ ভিএস-ই!” |