শহরের রাত-পথে সরেজমিন আনন্দবাজার
যান-শাসনের ‘প্রহসনে’ মুখ্য ভূমিকা পুলিশের
সোমবার
রাত সাড়ে ১২টা। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়।
ট্রাফিক পুলিশ থেকে কিয়স্কের পুলিশ সকলের চোখের সামনেই সিগন্যাল ভেঙে গাড়ি চালানোর ‘প্রতিযোগিতা’ তুঙ্গে। মোটরবাইক থেকে ট্রাক, মুখোমুখি বা আড়াআড়ি ভাবে নিজের খেয়ালে চলতে-চলতে কখনও হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ছে অন্যটির ঘাড়ে। এরই মধ্যে দু’টি ট্রাকের সংকীর্ণ ফাঁক গলে বেরিয়ে গেল মোটরবাইক।

রাত ১টা ১৫। গ্রে স্ট্রিট-যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ সংযোগস্থল।
এক জন ট্রাফিক পুলিশ, একটি পুলিশের গাড়ি। হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল বাঁশবোঝাই দশ চাকার একটি ট্রাক। ট্রাফিক পুলিশকর্মী ‘প্রিজম্যাটিক গার্ডরেল’ দিয়ে সেটিকে আটকাতে গেলে তাতে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে গেল ট্রাকটি। গাড়িটি তখনও অনড়। তার ‘চোখ’ পরের ট্রাকটিতে। দ্বিতীয় ট্রাকের খালাসি ততক্ষণে ‘পরিচিত’ ভঙ্গিতে জানলা দিয়ে হাত বার করেছেন। দু’আঙুলের ফাঁকে ধরা একটি নোট।

রাত প্রায় পৌনে দুটো। মহাত্মা গাঁধী রোড এবং চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের সংযোগস্থল।
পণ্যবাহী গাড়ির দাপটে নিতান্তই অসহায় লাগল দুই ট্রাফিক কনস্টেবলকে। আড়াআড়ি দু’টো রাস্তা দিয়ে একইসঙ্গে গাড়ি চলছে। সম্প্রতি নিয়ন্ত্রণহীন টাটা সুমো-ট্রাকের সংঘর্ষে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনাস্থল মিনিট পাঁচেকের পথ। সেখানে পুলিশকর্মী ও ভ্যান থাকলেও এখানে সেই ‘নজরদারি’ চোখে পড়ল না।

শ্যামবাজার মোড়

শিয়ালদহ


চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ
মঙ্গলবার
রাত প্রায় ১১টা। বেহালা চৌরাস্তার মোড়।
কাঠের গুঁড়ি-বোঝাই অগুনতি লরির মধ্যে ক’টি পিছনের গাড়ির চালককে ‘সতর্ক’ করার লাল আলো জ্বালিয়ে যাচ্ছে, তা হাতে গুনে বলা যায়। সিগন্যালের লাল আলোর তোয়াক্কা না-করে লরির সামনে দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল বেশ কয়েকটি মোটরবাইক (চোখে পড়ল হেলমেটহীন চালক-আরোহীও)। ঠাকুরপুকুরের দিক থেকে (প্রায় অদৃশ্য ‘স্টপলাইন’ পেরিয়ে) চৌরাস্তায় পড়ার মুখে বাঁ-দিকের খর্বাকৃতি সিগন্যাল পোস্টটি গাছের আড়ালে এমন ভাবে ঢাকা যে, বড় গাড়ির পিছনে থাকা ছোট গাড়ির পক্ষে সেটি দেখা মুশকিল। পরের সিগন্যাল পোস্টটি বেখাপ্পা ভাবে মোড় ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে।

রাত সওয়া ১২টা। রানিকুঠি মোড়।
কিয়স্কটি তালাবন্ধ। কাছেপিঠে দেখাও নেই কোনও পুলিশকর্মীর। যে কোনও দিক থেকে আসা ছোট-বড় বিভিন্ন গাড়ির অধিকাংশ চালকই নিয়মের তোয়াক্কা করছেন না। কিয়স্ক বন্ধ থাকায় যেন কিছুটা ‘বাড়তি’ স্বস্তি তাঁদের। রাত দেড়টা। গড়িয়াহাট মোড়। রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ধরে রুবির দিকে যাওয়া অধিকাংশ গাড়িই সিগন্যালের লাল আলোর নিষেধাজ্ঞা মানছেন না। একমাত্র মোটরবাইকে কর্তব্যরত দুই পুলিশকর্মীকে মোড়ে ঘুরঘুর করতে দেখে ‘বাধ্য’ হয়ে সতর্ক হলেন কয়েক জন চালক।
বেহালা চৌরাস্তা পার্ক সার্কাস
চলতি সপ্তাহের সোমবার হোক বা মঙ্গলবার, সাবেক কলকাতা হোক বা সংযোজিত এলাকা রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ট্রাফিক-বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যথেচ্ছ গাড়ি ছোটানোর এই ‘প্রবণতা’ নতুন নয়। গত শুক্রবার গভীর রাতে মহাত্মা গাঁধী রোড ও রবীন্দ্র সরণির সংযোগস্থলে টাটা সুমো ও ট্রাকের সংঘর্ষের পরে নিয়ম মেনে পুলিশের ‘তৎপরতা’ বাড়লেও রাতপথের যান-নিয়ন্ত্রণ হামেশাই লালবাজারের চিন্তার কারণ। ১ সেপ্টেম্বর থেকে দক্ষিণ শহরতলির বিস্তীর্ণ এলাকা কলকাতা পুলিশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরে তা বদলে গিয়েছে ‘দুশ্চিন্তা’য়। সোমবার রাতেও হরিশ মুখার্জি রোডে দুর্ঘটনায় আহত হন সাত জন। প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেকেরও অনেক কম পুলিশকর্মী নিয়ে দ্বিগুণ এলাকার রাতপথ সামাল দেওয়ার সমস্যা ভাবাচ্ছে লালবাজারের কর্তাদের।
পুলিশ সূত্রের খবর, রাত ১২টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত ‘বিয়ন্ড ট্রাফিক আওয়ার্স’ বা ‘ট্রাফিক-উত্তর সময়’। তখন ট্রাফিক পুলিশের বদলে মূলত স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল এবং থানা (কদাচিৎ কিয়স্ক)এই দুইয়ের হাতে চলে যায় যানশাসন। শুক্রবারের দুর্ঘটনার পরে সেই সময় কমিয়ে ২টো থেকে ৬টা করা হলেও গাড়ির গতি বাস্তবে কতটা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, উঠেছে সে প্রশ্ন। কর্তব্যরত পুলিশকর্মীদের বড় অংশের অভিমত: গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ক্যামেরা হাতে ‘সিগন্যাল’ ভাঙা গাড়ির ছবি তোলার চেয়ে অনেক বেশি জোর দেওয়া উচিত গতি কমানোর উপরে। কারণ দিনের অন্য সময়ের তুলনায় গাড়ির সংখ্যা অত্যন্ত কম থাকায় নিয়ম ভাঙার সঙ্গে গতি বাড়ানোর ‘স্বাভাবিক’ প্রবণতা হয় চালকদের। গাড়ি মোড়ের সিগন্যাল মানছে কি মানছে না দেখার থেকে মোড়ের আগেই (‘স্টপলাইন’-এ পৌঁছনোর আগে) যথেষ্ট ‘প্রিজম্যাটিক গার্ডরেল’ বসিয়ে গতি কমানোর চেষ্টা করা আবশ্যক। ঘটনাচক্রে মঙ্গলবার গভীর রাতে সংযোজিত এলাকার বিভিন্ন রাস্তায় দেখা গেল, গার্ডরেল বা ক্যামেরা কোনওটাই ‘উপযুক্ত’ সংখ্যায় নেই ট্রাফিক গার্ডগুলিতে। শুধু তাই-ই নয়, যে সব সার্জেন্ট বা কনস্টেবল বেলা থেকে ডিউটি করছেন, তাঁদেরই অনেককে ফের গভীর রাত পর্যন্ত রাস্তায় মোতায়েন থাকার ‘নির্দেশ’ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।‘ট্রাফিক-উত্তর সময়ে’ যান-নিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গে ডেপুটি কমিশনার (ট্রাফিক) দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “গাড়ির বেপরোয়া গতি রুখতে আরও উন্নত যন্ত্রপাতি ব্যবহার নিয়ে ভাবনা শুরু হয়েছে। পণ্যবাহী গাড়িচালকদের সচেতনতা বাড়াতে কর্মশালারও আয়োজন করা হচ্ছে। আইন প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গে চালক-আরোহীদের সচেতনতাও জরুরি।” আর সংযোজিত এলাকার ‘বাড়তি চাপ’-এর বিষয়ে কী ভাবছে পুলিশ? ট্রাফিক কর্তাদের বক্তব্য: সাবেক কলকাতা থেকে যে সব কর্মীরা ওই নতুন এলাকায় গিয়েছেন, তাঁদের আরও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। নিয়মিত চাপ সামলানোর মধ্যে দিয়েই এই কাজ হবে বলে তাঁদের ধারণা।

ছবি: দেবাশিস রায় ও রণজিৎ নন্দী
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.