সিন্ডিকেটের বিষ এমনই মাথায় চড়েছে যে, নির্দেশিকার ‘তাগা’ বেঁধে তার কতটা উপশম হবে, সে সম্পর্কে হিডকো’র কর্তারাই ঘোর সন্দিহান। তাঁদের একাংশের ব্যাখ্যা, রাজারহাট-নিউটাউনে সিন্ডিকেট-কারবারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে একশ্রেণির রাজনীতির কারবারীর স্বার্থ জড়িয়ে থাকার ফলেই নির্দেশিকা জারি করেও কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজারহাট-নিউটাউনে ‘সিন্ডিকেট-রাজ’ বন্ধ করার নির্দেশদানের প্রায় আড়াই মাস বাদে, গত সোমবার হিডকো কর্তৃপক্ষ একটি নির্দেশিকা জারি করেছেন। যাতে বলা হয়েছে, নিউটাউনে ইমারতি পণ্য কেনার জন্য কোনও নির্মাণসংস্থার উপরে সিন্ডিকেট জুলুম চালাতে পারবে না, নির্মাতারা জিনিসের মান-দাম-পরিমাণ যাচাই করে যেখান থেকে খুশি জিনিস কিনতে পারবেন।
কিন্তু ঘোষণাই সার। নির্দেশিকা জারির চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে, মঙ্গলবারই বিভিন্ন সিন্ডিকেটের মাথারা সাফ জানিয়ে দেন, তাঁরা হিডকো-র ‘ফরমান’ মানতে তৈরি নন। বুধবার নিউটাউনের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে সেই ‘দাপটের’ ছবিটাই চোখে পড়েছে। নির্দেশিকাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবাধে চলছে জুলুম-ব্যবসা। অথচ ‘জুলুমবাজদের’ বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে নালিশ জানাতে যাওয়ার সাহস কারও নেই। হিডকো ও পুলিশের কর্তারা যত আশ্বাসই দিন না কেন! |
যেমন পাথরঘাটার এক নির্মাণসংস্থার কর্তারা। যাঁরা তাঁদের নির্মীয়মাণ আবাসনের ভিতরে রাস্তা বানাতে বিশেষ ধরনের বিটুমিন’ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এক বিশেষজ্ঞ-সংস্থার তৈরি সেই বিটুমিন বর্ষার জলে সহজে নষ্ট হয় না। কিন্তু বিটুমিন বোঝাই গাড়ি পাথরঘাটায় ঢুকতেই রে-রে করে তেড়ে আসে সিন্ডিকেটের ছেলেরা। চোখ রাঙিয়ে বলে, বাইরে থেকে মাল আনা চলবে না। নির্মাণসংস্থাটির তরফে বোঝানোর চেষ্টা হয়, ওই বিশেষ বিটুমিন সিন্ডিকেটের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। “কিন্তু কোনও যুক্তিই ওরা মানল না।” জানাচ্ছেন এক কর্তা।
ফয়সালা কী হল?
সংস্থার ওই কর্তা জানাচ্ছেন, অগত্যা বিশেষ বিটুমিন দিয়ে রাস্তা তৈরির পরিকল্পনাই বাতিল করতে হয়েছে। যদিও এ নিয়ে কোথাও অভিযোগ দায়ের কথা তাঁরা মাথাতেও আনছেন না। ‘নির্দেশিকা’র কথা শোনার পরেও না। বরং তাঁরা বলছেন, “নির্দেশিকা বানিয়ে দিলেই জুলুম বন্ধ করা যাবে? এখানে কাজ করতে গেলে সিন্ডিকেটের কথা শুনে চলতে হয়েছে এত দিন। এখনও তাই হচ্ছে। হবেও।” |
একই রকম নৈরাশ্যের সুর এ দিন শোনা গেল রেকজোয়ানি মৌজার এক নির্মাতার গলায়। যিনি জানালেন, “আজ সিন্ডিকেটের এক জনকে নির্দেশিকার কথা বলতে গিয়েছিলাম। শুনে সে উল্টে বলল, এ বার থেকে তাদের মালই আরও চড়া দামে আমাদের নিতে হবে!”
এই যখন পরিস্থিতি, তখন ‘নির্দেশিকা’র ভবিষ্যৎ কী?
হিডকো-কর্তাদের কথায় আশাবাদের কোনও ছোঁয়া নেই। এক কর্তা বলেন, “প্রতিটা সিন্ডিকেটের পিছনে রয়েছেন এলাকার প্রভাবশালী নেতারা। তাঁদের মদতেই সিন্ডিকেটগুলো এতটা ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কোটি কোটি টাকার অবৈধ ব্যবসা। এ চক্র ভাঙা কঠিন।”
এলাকার রাজনৈতিক নেতারা কী বলছেন?
ডান-বাম নির্বিচারে তাঁদের সুরও মোটামুটি এক। মঙ্গলবার সিন্ডিকেটের পাশে দাঁড়িয়ে নির্দেশিকার বিরোধিতা ও হিডকো-র সমালোচনায় সরব হয়েছিলেন রাজারহাট-নিউটাউনের তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত। এ দিন স্থানীয় সিপিএম নেতা তথা রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভার চেয়ারম্যান তাপস চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, “নির্দেশিকা কেউ মানবে না। ও সব কথার কথা। হিডকো কারও সঙ্গে আলোচনা না-করেই এ সব করেছে।” আর রাজারহাট-গোপালপুরের বিধায়ক তথা রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর মন্তব্য, “শুধু নির্দেশিকা করলে হবে না। তা ঠিকঠাক মানা হচ্ছে কি না, সেটা দেখার সদিচ্ছাও থাকতে হবে হিডকো’র।” অন্য দিকে হিডকো-কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, সিন্ডিকেটগুলো নির্দেশিকা মানছে কি না, তা দেখার মতো পরিকাঠামোই হিডকো’র নেই। তাই নেতাদেরই উচিত ওই কাজে উদ্যোগী হওয়া।
আর এই চাপান-উতোরেই স্পষ্ট, হিডকো-র নির্দেশিকা-দাওয়াই আপাতত ‘ফেল।’ নিউটাউনে সিন্ডিকেটের ‘রাজ’ চলছে আগের মতোই। |