এই মুহূর্তে দু’জনে বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক জোটে। কিন্তু আঞ্চলিক উন্নয়নের পথ ধরে ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নীতীশ কুমার।
আকরিক লোহা, কয়লা থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সাহায্য উন্নয়নের পথে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর মতোই এমনই বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে বিহারের মুখ্যমন্ত্রীকে। সেই সব সমস্যার মোকাবিলায় পূর্র্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিকে নিয়ে জোট বেঁধে একটি মঞ্চ গড়তে সক্রিয় হয়েছেন নীতীশ। এ ব্যাপারে তিনি মমতার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগও করেছেন।
বিপরীত জোটে থাকা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে একটাই কথা তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তা হল, এই অঞ্চলে উন্নয়নের স্বার্থে যদি একযোগে সরব হওয়া যায়, তা হলে সেই দাবি আরও জোরালো হবে। এর মধ্যে রাজনীতি নেই। গোটা বিষয়ের লক্ষ্যই হল উন্নয়ন।
গত কালই পটনায় মুখ্যমন্ত্রী নিবাস থেকে মমতাকে ফোন করেন নীতীশ। পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়েছেন মমতা। তার পরে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে যে ভাবে রাজ্যের উন্নয়নের চেষ্টা করছেন, তার ভূয়সী প্রশংসা করেন নীতীশ। মমতাও নীতীশ কুমারকে কলকাতায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। জবাবে নীতীশ জানান, “আপনি যে দিন ডাকবেন, সে দিনই আমি কলকাতায় পৌঁছে যাব।”
নীতীশের সঙ্গে মমতার ‘সুসম্পর্ক’ নতুন নয়। তবে সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশে ভোটযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে সেটি আরও দৃঢ় হয়েছে। সেখানে নীতীশের জেডি (ইউ)-এর সঙ্গে মমতার তৃণমূলের বোঝাপড়া শুরু হয়েছে। এনডিএ-র শরিক হলেও উত্তরপ্রদেশে জেডি (ইউ)-এর সঙ্গে বিজেপির সমঝোতা ভেঙে গিয়েছে। নানা কারণে নীতীশদের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্ক এখন এক রুক্ষ আবহাওয়ার মধ্যে দিয়ে চলেছে। উত্তরপ্রদেশে নীতীশ বিহারের সাফল্যকে তুলে ধরে যে সব এলাকায় প্রচার করছেন, রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা সুশীল মোদী ঠিক সেই সব কেন্দ্রে গিয়েই পাল্টা প্রচারে ‘বিহার মডেল’-এ নিজের দলের গুণগান করছেন। তাই মমতার সঙ্গে নীতীশের এই সমঝোতা বা সন্ধি এমন একটা সময়ে হচ্ছে, যখন বিজেপির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে যেমন চিড় ধরেছে, তেমনই কংগ্রেস-তৃণমূল সম্পর্কও যথেষ্টই স্পর্শকাতর অবস্থায় রয়েছে।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, নিছক পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির মধ্যে সমন্বয় বাড়াতেই কি এই সন্ধির উদ্যোগ? নাকি এর পিছনে আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে ঐক্য রচনার কৌশলও রয়েছে?
নীতীশ অবশ্য বলছেন, “এর মধ্যে রাজনীতি দেখবেন না। এখানে মূল প্রশ্ন উন্নয়ন। মমতাও উন্নয়নমুখী। রাজ্যের উন্নয়নের জন্য তাঁরও আর্থিক সাহায্য দরকার। বিহারও উন্নয়নের ক্ষেত্রে একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি।” কিন্তু সম্পর্ক যতই খারাপ হোক, নীতীশ এখনই এনডিএ ভেঙে আসার অবস্থায় নেই। জেডি (এস) সূত্রেই এ কথা মেনে নেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, গত বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের পিছনে বিজেপি-র অবদান তো অনস্বীকার্য বটেই, এখনও বিহারে একার ক্ষমতায় জেতার অবস্থায় নেই নীতীশ। পরের বিধানসভা নির্বাচন হতে এখনও ঢের দেরি। সেটা হবে লোকসভা নির্বাচনের পর, ২০১৫ সালে।
কিন্তু নীতীশের সমস্যা অন্যত্র। এ বছরের শেষে গুজরাতে বিধানসভা নির্বাচন। সেখানে নরেন্দ্র মোদী ভাল ফল করবেন, সেটাই বিজেপির প্রত্যাশা। কারণ, মোদী সেখানে উন্নয়ন করেছেন। ‘গুজরাত অস্মিতা’কেও পুঁজি করে এগোচ্ছেন। কিন্তু গুজরাতে ভাল ফলের ভিত্তিতে সঙ্ঘ ও বিজেপি যদি মোদীকেই প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে, তা হলে তখনই এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে আসা ছাড়া জেডি (ইউ)-এর আর কোনও গতি থাকবে না। ফলে ২০১৫ সালে বিজেপিকে বাদ দিয়ে ফের ক্ষমতায় আসতে গেলে নীতীশকে এখন থেকেই তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে।
অনেকে মনে করছেন, মমতা যেমন ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে পা রাখছেন, মণিপুর-উত্তরপ্রদেশে প্রার্থী দিচ্ছেন, বিহারেও দলের বিস্তার করছেন, ঠিক তেমনই আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে নীতীশ কুমারও ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক ব্লক তৈরি করছেন। অর্থাৎ দু’জনই দুই বড় দলের প্রতি নিজেদের নির্ভরতা কমানোর চেষ্টা করছেন। পশ্চিমবঙ্গে যেমন ৪২টি লোকসভা কেন্দ্র রয়েছে, তেমনই বিহারেও রয়েছে ৪০টি লোকসভা আসন। এর মধ্যে বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করা ওড়িশার নবীন পট্টনায়েককে সঙ্গে নিলে সংখ্যাটি আরও বেড়ে যায়। ফলে এই রাজ্যগুলি যদি একজোট হয়, তা হলে কংগ্রেস বা বিজেপির সঙ্গে দর কষাকষির জায়গাটিও আরও শক্ত হয়।
মমতার মা মারা যাওয়ার পরে নীতীশ শোক জানিয়েছিলেন। আবার মমতা যখন রেলমন্ত্রী, নীতীশ দিল্লিতে বৈঠক করেন। তখন মমতা তাঁকে এগিয়ে দিতে রেলভবনের নীচে পর্যন্ত আসেন। নীতীশের দাবিগুলিও মমতা মেনে নেন। লালু প্রসাদ কংগ্রেসের সঙ্গী হওয়া সত্ত্বেও মমতা নীতীশের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছেন। যদিও মমতাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “ব্যক্তিগত সম্পর্ক অনেকের সঙ্গেই থাকে। আমাকে অনেক মুখ্যমন্ত্রীই ফোন করেন। এর মধ্যে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। উন্নয়ন নিয়ে যতই বোঝাপড়া হবে, ততই ভাল।” |