সম্প্রতি সুন্দরবন সফরে গিয়ে আয়লা-বিধ্বস্ত এলাকায় বাঁধ নির্মাণের জন্য গ্রামবাসীদের জমি দিতে বার বার আবেদন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু আদৌ কোনও ফল হবে কি তাতে? বাঁধের জমি পেতে নানা সমস্যার কথা জানিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসকদের মহাকরণে পাঠানো চিঠি থেকে প্রশাসনের উদ্বেগের ছবিটা পরিষ্কার হয়েছে। এক দিকে চাকরি-সহ উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের দাবি, অন্য দিকে শত শত একর সরকারি খাস জমি জবরদখল হয়ে যাওয়া মূলত এই দুই সমস্যা সমাধানে জেলা প্রশাসন কোন পথে এগোবে, মহাকরণের কাছে তার নির্দেশিকা চাওয়া হয়েছে।
২০০৯ সালের ২৫ মে আয়লায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। বিধ্বস্ত এলাকায় ৭৭৮ কিলোমিটার ‘ব্রিকব্লক’ বাঁধ দিতে পরের বছরের জুলাই মাসে ৫০৩২ কোটি টাকা প্যাকেজ অনুমোদন করে যোজনা কমিশন। বাঁধ দিতে জমি লাগবে ১৪ হাজার একর। ঠিক হয়, দু’পর্যায়ে কাজ হবে। প্রথম পর্যায়ে ২৬৩ কিলোমিটার বাঁধ দিতে জমি লাগবে প্রায় ৬০০০ একর। বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য বাম আমলে শুরু হওয়া কাজের বয়স ইতিমধ্যে দেড় বছর পেরিয়েছে। অথচ, হাতে পাওয়া গিয়েছে মাত্র ১৪০ একর জমি। নির্মাণের কাজও সবে শুরু হয়েছে।
কিন্তু কেন এই হাল?
|
জমি-চিত্র |
বাঁধ হবে
৭৭৮ কিলোমিটার |
জমি দরকার
১৪ হাজার একর |
প্রথম পর্যায়ে চাই
৬০০০ একর |
পাওয়া গেছে
১৪০ একর |
|
নতুন সরকার আসার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছিলেন, আয়লার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রতিরোধে বাঁধ নির্মাণ করবে সরকার। তার জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হবে। জমিদাতাদের পরিবার পিছু এক জনকে সরকারি চাকরিও দেওয়া হবে। কিন্তু দেখা যায়, গোটা বাঁধ প্রকল্পের জন্য যে টাকা অনুমোদিত হয়েছে (৫০৩২ কোটি), নতুন সরকারের ঘোষিত নীতি মেনে প্যাকেজ দিতে গেলে শুধু ক্ষতিপূরণ বাবদই তার সিংহভাগ চলে যাবে। আবার পুরনো আইনে চাকরি বা অন্য অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধার বিধান নেই। পুরনো আইনে জমি অধিগ্রহণ করে ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে প্রশাসন। গত সোমবার রায়দিঘিতে জমিদাতাদের চাকরির দাবিতে পিছু হটতে হয়েছে প্রশাসনকে। জমি নিলে চাকরি দিতে হবে, এই দাবি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকাতেও।
রাজ্য প্রশাসনের বক্তব্য, নতুন ভূমি আইন এখনও কার্যকর হয়নি। তাই চাকরি দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। প্রশাসনের অন্য একটি অংশের বক্তব্য, কোন আইনে জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে, জমিদাতারা তা বিবেচনায় নারাজ। তাঁদের সাফ কথা, জমি দিলে চাকরি মিলবে, এ কথা স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন। সুতরাং তাঁদের চাকরি চাই।
এর পাশাপাশি, দুই জেলাতেই অনেক জায়গায় সরকারি জমি ‘দখল’ হয়ে যাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে বলে মহাকরণকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন দুই জেলাশাসক। তাঁদের বক্তব্য, কোথাও ‘খাস’ জমি দখল করে বসতি গড়ে উঠেছে, কোথাও বা চাষ-আবাদ হচ্ছে। বিস্তীর্ণ এলাকায় নদীর পাড়ের জমিতে পাট্টায় চাষ হচ্ছে। আইন অনুযায়ী জবরদখল করা জমির দখল নিলে কোনও ক্ষতিপূরণ দিতে পারে না সরকার। তা ছাড়া খাস জমি দখল করে কয়েক দশকের এই মৌরসিপাট্টা হটিয়ে জমির দখল নেওয়াটা সহজ কাজ নয়। তা হলে সমাধানের উপায় কি? সেটা জানতে চেয়েই মহাকরণে চিঠি দিয়েছেন দুই জেলাশাসক।
সমস্যাটি নিয়ে গত সপ্তাহে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন সংশ্লিষ্ট আধিকারিকেরা। সূত্রের খবর, জোর করে উচ্ছেদ না করে কী ভাবে ওই জবরদখল হওয়া জমি বাঁধ নির্মাণের জন্য নেওয়া যায়, তার পরিকল্পনা তৈরি করতে বলা হয়েছে ভূমি দফতরকে। তবে নতুন সরকার জোর করে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে। তাই বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে বেআইনি দখলদারদেরও কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে প্রত্যেকের বিষয়গুলি আলাদা ভাবে বিবেচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন এক সরকারি মুখপাত্র।
বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের জন্য কেন্দ্র ইতিমধ্যে ৫২৫ কোটি ও রাজ্য ১০৪ কোটি টাকা দিয়েছে। জমি অধিগ্রহণ ও নির্মাণ কাজ শুরুর জন্য দুই জেলা প্রশাসনের হাতে ২৯১ কোটি টাকা তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জমির ফেরে খরচ হয়েছে সামান্যই। এ বছর মার্চ মাসের মধ্যেই পুরো প্রকল্প শেষ করার সময়সীমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা হবে না বুঝেই দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ২০১৫ সালের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা বলে নতুন করে কেন্দ্রকে বার্তা পাঠিয়েছে রাজ্য। কিন্তু জমির এই জটিল সমস্যা মিটিয়ে সেটাও আদৌ সম্ভব হবে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া বলেছেন, “জমি হাতে পেলে কাজ শুরু হবে। এ ছাড়া দফতরের কিছু করার নেই।” |