প্রবন্ধ...
ধন্যি মেয়ে
ন্যি মেয়ে বটে এই বিদ্যা বালন! এতাবৎ কাল যে কিনা পর্দায় পরিণীতা, নৈশভোজে সর্বাঙ্গ ঢাকাঢুকি সব্যসাচী মুখার্জি, সে ঝটসে উন্মুক্ত করে দিল উপচোনো চোলি আর থলথলে কোমর! তবে আমরাও নিশ্চিত, যতই বেঢপ বেআব্রু হয়ে যাক, ঘরে আছে পার্সোনাল ট্রেনার, ফিরিয়ে দেবে শেপ। তাই উরিত্তারা, যেমনই বিদ্যা তেমনই নাসির, কী অভিনয়। এই বলি আমরা। উদ্দেশ্য সফল পরিচালকের। বিদ্যা ও রেশমা/সিল্ক, এ দু’টি এমনি পৃথক হয়ে প্রকট হল বলেই না আমরা বুঝতে পারলাম এটি তৃতীয় স্তরের শরীরী আবেদন নয়, বরং তা নিয়ে ফাঁদা কাহিনি। রেশমার কাজলবিহীন সারল্যে বুঝলাম নিজের গতরখানিই একমাত্র মূলধন বুঝে সেইটে কাজে লাগানো একটা নিঃসংকোচ নির্মোহ হতে পারে। নাইন এক্স নলিনী বা ডিসকো শান্তি বা সিল্ক স্মিতা, এরা এক-একটা লড়াইও লড়তে পারে নিজেদের শরীরী আবেদনকে ব্যবহার করে।
এ চাওয়ার ও সার্থক বোধ করার অন্য একটা মডেল। যেখানে নাম হল, না বদনাম, সেই বিভাজনটাই নেই। একটি মেয়েকে যে ভাবে যে অনুপানগুলি দিয়ে কেবল মাত্র যৌন উত্তেজনা হিসেবে ব্যবহার করা যায়, সে যখন উল্টে ওগুলোকেই করে তোলে স্বেচ্ছাসংকলিত মূলধন, তখন শোষণ কি আর শোষণ থাকে তত, বা শোষক শোষক? খেলার ছকটা তখন বদলে যায় না? তখন ভাবতে হয়, এই ভাবে দেখানো হলে তা পুরুষতন্ত্র, দেখলে পুং-দর্শকাম, কেননা নারীশরীর সেখানে নারীটির সামগ্রিক সত্তা থেকে সরিয়ে শুধুই বডি। কিন্তু, এ ক্ষেত্রে খেলাটা আর একটু ভিন্ন, জটিল হয়ে যেতে পারে। সিল্ক জানে যে সে নায়িকা হতে পারবে না, তাই আইটেমে যা বেচতে বাধ্য করে প্রোডিউসার কাঁড়ি টাকা তোলে ঘরে, সেইটে সে জ্ঞানত ব্যবহার করে। উত্তেজক গতরের সম্পূর্ণ ঢলানি বেচে, নির্মোহ।
হয়তো এ কারণেই বিদ্যা বালন’কে লাগে। এইটা বোঝাতে যে, অভিনেত্রীর সুচারু সুকুমার মুখে যে সরল মনুষ্যত্ব, তা প্রকৃত। আর ক্যামেরা পাতলেই যে গর্মি, তা ফুটিয়ে তোলা। এবং এইটা না করা হলে হয়তো আমরা লড়াইয়ের অন্যতর চেহারা, ঘুরে দাঁড়ানো, ফন্দি-ফিকির বুঝতে পারি না। এইখানে নারীবাদী তত্ত্ব নিজেকে প্রসারিত করে যে, একমাত্র ব্যবস্থার প্রতিরোধেই শোষিতের ক্ষমতা তৈরি হয় না। যা আমাকে ব্যবহার করে, তার খেলার দানগুলো উল্টে খেলে আমি স্ব-ইচ্ছা দেখাতে পারি। ঘর ভাঙাচুরো বলে বাথটাবে স্নান করতে করতে ইন্টারভিউ দিলে ফোটোগ্রাফার সাবান-ফেনাটুকু ছাড়া দেখতে পায় না, মলাটে সুপারস্টারকে সরিয়ে সিল্ক এসে যায়। ‘এজেন্সি’ নয়? কাস্টিং কাউচ বা পর্দায় কাম উৎপাদন, কিছুই তাকে পুরো যৌনবস্তু হিসেবে তৈরি করে না, কেননা এগুলি তার কম্প্রোমাইজ নয়, বরং ক্ষমতা তৈরির জন্য ব্যবহার করা পদ্ধতি। সুরিয়াকান্ত ভাবছে এ তার নারীবাজ ফুর্তি, রেশমা এ দিকে তার স্বপ্নের নায়কের সঙ্গে পাঁচশো আদর করছে। অবশ্য প্রেম হয়ে যায়, একতরফা, তাতেই ক্যাচাল ঘটে। প্রেম ফেরত আসে না, আর সিল্ক নিজেকে প্রস্তুত রাখে না তার জন্য। আত্মহত্যা করে।
ভিকটিমহুড এটা নয় যে, সুরিয়াকান্ত বলছে, সিল্ক হল অন্ধকারের নির্লজ্জ কামনা, দিনমানের দাম্পত্যের সম্মান তার জন্য নয়। সিল্কের কবেই বা চাহিদা ছিল সম্মানিত যৌনতা! একদা আইটেম-স্পর্ধায় মট-মট করা সিল্ক যদি সত্যিই ‘বেছে নিত’ পর্নোনায়িকা হিসেবে রোজগার, তা-ও ভিকটিমহুড হত না। (পর্নো-অভিনেত্রী যদি জীবনযাপনের জন্য নিজ যৌন-শরীরকে ভাড়া খাটায়, তা-ও তার লড়াই, সে নিজে যদি ভাবে। চাইলেই তো আর আমি-আপনি আইটেম টু পর্নো দেশ থেকে তুলে দিতে পারব না।) ভিকটিমহুড ওইটা যে সে নিজেকে দেখল আপসহীন। প্রমাণ করল নাসিরুদ্দিনের সংলাপ, সিল্করা আসবে যাবে, থাকবে কিন্তু সুরিয়াকান্তরাই। ভিকটিমহুড তখনই, যখন সারাটা ছবি/জীবন খেলাচ্ছলে সীমাহীন ঔদ্ধত্য দেখিয়ে শেষে অপ্রাপ্ত বধূবেশে তার আত্মহনন দেখে আমাদের বুকটা মুচড়ে ওঠে। যে, আহা রে, অপ্রাপ্ত থেকে যাবে সিঁথের সিঁদুর ও বেনারসি এই মেয়েদের। সিল্ক কি তাই ভাবল শেষে!
আমরা তখনই ভিকটিম, যখন আমরা নিজেদের সরিয়ে নিই, নিজেদের হেরো ও হৃতসর্বস্ব ভাবি। নিজেকে হেরো ভাবার আগে পর্যন্ত কেউ বঞ্চিত হতেই পারে না। যেমন ধরুন তানিশা, ‘বেডরুম’-এ। যা করে সে, কর্পোরেট কলগার্লগিরি, জেনেশুনে, স্বেচ্ছাকৃত। বেডরুমের অনিবার্য কিছু কম্প্রোমাইজ, আলসেমি ও অভ্যস্ততার ফাঁদ আছে। পাওলি জানে, ঘরের বউ হয়ে থাকার আয়েশ সে ছাড়তে পারবে না, রাহুল আর পার্নো জানে বিয়ে করল বটে অভ্যস্ততার দাম চোকাতে, কিন্তু এ নয় যে এতে করে থেমে যাবে অন্য সম্পর্কের দিকে গিয়ে নিজের সংকট মোচনের চেষ্টা। এরই মধ্যে প্রিন্স চার্মিং ঘোড়া চালিয়ে এসে লাল জুতো কিনে দিল না বলে নীতিজ্ঞান তোয়াক্কা-না-করা দপদপে মেয়েটা, তানিশা, কড়িকাঠে ঝুলে পড়ল। ফের বধূবেশ, ফের আমাদের বুক হা-হা করে উঠল, আহারে, ঘর-বর না পেয়ে এই হল! যে ছবিটা শরীর নিয়ে মোটামুটি নো-ন্যাকামি চাল দেখায়, সে কি ভাবল প্রিন্স চার্মিং না এলেই তানিশা অপশনবিহীন হবে! অর্থাৎ, থেকে যেতে হবে কলগার্ল। যেন, চাইলেই তার অন্য কাজ করার উপায় নেই। কখনও তো এটাও দেখিনি যে, কলগার্ল হয়ে তার চুনরি মে দাগ লেগেছে, আর সে কলঘরে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করে ধুয়ে নিচ্ছে কালি। বরং, এই মুহূর্তে বোঝার ছিল, প্রিন্স চার্মিং-টার্মিং হবে খনে, আসলে ওই লাল হিল-জুতোটাই আমার প্রেম। নিজের প্রতি। আজ একটা প্রিন্স চার্মিং এসে জুতো না কিনে দিলে গলায় দড়ি দেব, না একাকিনী জুতো জোড়া পরে হাঁটতে থাকব ভবিষ্যতের দিকে, যা বিপুল সম্ভাবনাময়, এই সব প্রতিশ্রুতির দিকে বেডরুম এগোয় না।
আচ্ছা বলুন তো, রাখী সাবন্ত রেশমা সাজলে যা, তত ভালগার লাগল না বিদ্যার তামিল ব্রাহমিন আর্য টান সমৃদ্ধ মুখখানির জন্য, তা তত বুদ্ধি দিয়ে বুঝতাম আমরা? যে চর্বি ও অনর্গল খিস্তি-খেউড় থেকে নিজেদের বিযুক্ত করে নারীবাদী লড়াই এটসেটরা আলোচনা করছি, তা করতাম সিলিকন ইমপ্ল্যান্ট-এর অতিরিক্ত পৃথুলতায়? বিদ্যার গলায় খিস্তি-খেউড় তত অশ্লীল শোনাল না, রাখী সাবন্ত পাতি জলতেষ্টা পেয়েছে বললে যেমন চাঁছাছোলা ও বেতরিবৎ শোনায়। যারা জানে তারাই জানে, সেই অসম্ভব শারীরিকতা কেমন সিল্ক স্মিতার! এদের ব্যক্তিটুকুকে খুঁজে বার করতেই হয়তো বিদ্যাকে লাগে, নয়তো মধ্যবিত্ত বুঝতে পারবে না। ভুল বুঝবেন না, আমিও চাই বিদ্যার হাতে এ বার উঠুক শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার। আমি বরং নিজেকে বঞ্চিত ভাবার মধ্যে যে রোম্যান্টিসিজম, তা শুধু নিজের সম্ভাবনাই নষ্ট করে না, নিজেকে আসলে তা বঞ্চিতও করে নিজের প্রতি ভালবাসা থেকে। সেই কথাটা সিল্কের এত দিন পরে তানিশা বুঝবে না?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.