ভালবাসা কারে কয়? উত্তরটি কঠিন। যুদ্ধ কাহারে কয়? উত্তরটি সহজ। কলিকাতা ময়দানে শেষ শীতের রৌদ্রে শরীর মেলিয়া কিছু শিশু কি সেই সহজ উত্তরই শিখিল? যুদ্ধ মানে অস্ত্র, শস্ত্র, পরিখা। হাতের নাগালে এ রকম কয়েকটি বস্তুই মজুত, তাই দিয়াই রণলীলার স্বাদ লইবার আয়োজন। অথচ, আগ্নেয়াস্ত্রের ঘোড়ায় হাত রাখিয়া কী বুঝিল শিশুমানব? একটি অস্ত্রের এক পারে সেই বালক হাত রাখিয়াছে আগ্নেয়াস্ত্রে। অন্য পারে কে? নিশ্চিত, কচি করস্পর্শমাত্রে একটি বুলেট ছুটিয়া যায়। বাস্তবে না হইলেও স্বপ্নে তো বটেই। কাহার দিকে? নিজেকে কোন স্বপ্নের ভিতরে আনিয়া ফেলে বালক? বা, তাহাকে কোন স্বপ্নের ভিতরে ঠেলিয়া দিতে চাহে তাহার পরিপার্শ্ব? সত্য, বালকটি আগ্নেয়াস্ত্র না-ছুঁইলে সহসা পৃথিবীটি শুদ্ধ ও সাত্ত্বিক হইবে না। ছুঁইলেই বা কী মহাভারত অশুদ্ধ হইবে, সেই প্রশ্নও উঠিয়া আসে। এক্ষণে চতুর্দিকে যে বিনোদন-মায়া, তাহার একটি মুখ্য অবলম্বন হিংসা। প্রবল, প্রগলভ এবং কার্যত এক প্রকার অকারণ হিংসা। সেই হিংসাই এই মুহূর্তে দর্শনীয় বস্তু। আগ্নেয়াস্ত্রের সহিত সাক্ষাৎ মোলাকাতে শিশুরা কি সেই বিপুল হিংসাক্ষেত্রেই নিজেদের দর্শন করিল? আগ্নেয়াস্ত্রটি চালাইল, সত্য না হইলেও অন্তত মনে মনে!
অস্ত্রের প্রতি শিশুদের টান অতীব বাস্তব একটি ঘটনা। ‘সোনার কেল্লা’ এবং ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ উভয় ছবিতেই দেখা যায়, ছোট শিশু অপলকে দেখিতেছে ফেলুদার হস্তে রিভলভার। সেই টান এখনও চলিতেছে। সেই স্বপ্ন এখনও প্রতিনিয়ত ঘুরিতেছে বিনোদন-বিশ্বে। বাস্তব এক্ষণে নিছকই রক্তমাংসে আবদ্ধ নাই। পরিভাষায় তাহা এই মুহূর্তে ‘ভারচুয়াল’! তাহাতে রণক্ষেত্র সহসা জীবন্ত হইয়া উঠে কম্পিউটার বা টেলিভিশনের পর্দায়। সেখানে হত্যা করিতে কোনও বাধা নাই, বরং করিতে পারিলে ‘পয়েন্ট’ আছে। লক্ষ্য নির্ভুল হওয়া দরকার। সতর্কতা চাই প্রকৃত সৈনিকের ন্যায়। শত্রু শিবিরে ঢুকিবার পরে ভিডিয়ো গেম-এ মগ্ন শিশুটি সাক্ষাৎ যোদ্ধা। তাহার দিকে বন্দুক তাক করা আছে। সে-ও বন্দুক তাক করিয়াছে অন্যদের প্রতি। মারি অরি পারি যে কৌশলে। শুধু মারিলেই চলিবে না, যথাযথ রূপে, খুবই বুদ্ধি সহকারে হত্যা করিতে হইবে। হিসাব করিতে হইবে, কী কী অস্ত্র মজুত, কয়টি ফুরাইল, কয়টি এখনও পাওয়া যাইতে পারে। ভিডিয়ো গেম-এর ভিতরে একটি রক্তাক্ত স্বপ্ন। ভিডিয়ো গেম ফুরাইলেও রণক্ষেত্রটি ফুরায় না। ফুরায় যাহা, তাহা ফুরায় শুধু চোখেই। অন্য ভাবে তাহা ফিরিয়া আসে। অন্যকে না মারিলে নিজের মুক্তি নাই। নিজস্ব জীবন নাই। হয় সে মারিবে, অন্যথায় অন্য কেউ তাহাকে হত্যা করিবে। সহযোগী থাকিলেও তাহা সেই নিধনেরই জন্য। সহযোগ আসলে একটি রণকৌশল। যে ভাল পারিবে, সেই বাঁচিবে। যুদ্ধ মানে শত্রু শত্রু খেলা। সেই খেলাই যদি বাস্তবের বিম্ব হইয়া উঠে? একটি রক্তাক্ত স্বপ্ন চতুর্দিকে ঘুরিতেছে। শীতের ময়দানে কি তাহাই ফিরিয়া আসিল? পৃথিবীর একটি বিচিত্র উত্তরাধিকার রহিয়া যাইতেছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হস্তে। একটি অগ্নি পথ! |