বহু যুগ আগে যুব সমাজের প্রতি বঙ্গসন্তান এক মনীষীর পরামর্শ ছিল, গীতা পাঠের বদলে মন দিয়ে ফুটবল খেললে তারা অনেক বেশি স্বর্গের কাছাকাছি যাবে! ঘটনাচক্রে, স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম সার্ধ-শতবর্ষে সেই ‘পরামর্শ’ই যেন মেনে নিল সিপিএম!
কেরলে সিপিএমের ২০ তম রাজ্য সম্মেলনের আসর এ বার বসছে রাজধানী শহর তিরুঅনন্তপুরমে। বিভিন্ন জেলায় ঘুরে-ফিরে হলেও তিরুঅনন্তপুরমে রাজ্য সম্মেলন হচ্ছে দীর্ঘ কাল পরে। তাকে স্মরণীয় করার উদ্যোগে সিপিএম নেতৃত্ব আয়োজন করেছেন পুরোদস্তুর একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতার। চিরাচরিত তাত্ত্বিক আলোচনা সভা এবং প্রদর্শনীর চেনা উদ্যোগের পাশাপাশি তিরুঅনন্তপুরম জেলা জুড়ে ছড়িয়ে এক ডজন স্পোর্টস ইভেন্টের আসর বসানো হয়েছে। যেমন, জেলার ১৮টি জোনাল কমিটির প্রতি এলাকা থেকে একটি করে ক্রিকেট এবং ফুটবল টিম নামানো হয়েছে। দু’শো থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত আর্থিক পুরস্কারের বন্দোবস্ত থাকছে। তার চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ, ফুটবল বা ক্রিকেট ময়দানে বা মিনি ম্যারাথনে পার্টি ক্যাডারদের সঙ্গে টক্কর নেওয়ার জন্য দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে আম জনতার জন্য!
দলেরই একাংশের ব্যাখ্যায়, সাবেক ‘গোঁড়ামি’র আবরণ ছেড়ে বেরোনোর চেষ্টা শুরু করেছে একবিংশ শতাব্দীর সিপিএম। মতাদর্শগত অবস্থানকে সময়োপযোগী করার ‘তাত্ত্বিক উদ্যোগে’র সঙ্গে সঙ্গেই খেলার মাঠে ‘জনসংযোগের মুক্ত পথে’ হাঁটতে চাইছে তারা। রাজ্য সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির প্রধান তথা কেরলের প্রাক্তন ক্রীড়ামন্ত্রী এম বিজয়কুমারের কথায়, “সকলের সঙ্গে মেলামেশার জন্য খেলার মাঠের চেয়ে উপযুক্ত জায়গা হয় না! শুধু আমাদের দলের ক্যাডাররাই নন। এই প্রতিযোগিতা সকলের জন্য উন্মুক্ত।” সাইনি উইলসন, পদ্মিনী টমাস, উইলসন চেরিয়ান, আব্দুল রাজ্জাকের মতো কেরলের খ্যাতনামা ক্রীড়াবিদেরা এখন তিরুঅনন্তপুুরমের নানা প্রান্তে নানা ইভেন্টে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কেরল সিপিএমের রাজ্য সম্মেলন হচ্ছে ৭-১০ ফেব্রুয়ারি।
তবে সিপিএম ‘খোলা হাওয়া’ আনার চেষ্টা করবে আর তা নিয়ে বিতর্ক হবে না তা হওয়ার নয়! ক্রীড়া প্রতিযোগিতা নিখাদ মনোরঞ্জনের উপাদান হিসাবে থাকলেও রাজ্য সম্মেলন উপলক্ষেই একটি চিত্র প্রদর্শনী বিতর্কের মুখে পড়েছে যিশু খ্রিস্টের একটি ছবির জন্য। ‘মার্ক্স ইজ কারেক্ট’ শীর্ষক ওই প্রদশর্নীতে খ্রিস্টের একটি ছবির সঙ্গে সংক্ষেপে তাঁর জীবনকাহিনি বর্ণনা করে তাঁকে ‘সমাজ সংস্কারক’ হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কমিউনিস্টদের প্রদর্শনীতে খ্রিস্টের ছবি এমনিতেই চোখ কপালে তুলেছে রাজনৈতিক শিবিরের! উপরন্তু, ক্যাথলিক চার্চের (কেরলের রাজনীতিতে গির্জা যথেষ্ট ‘প্রভাবশালী’) একাংশ বলতে শুরু করেছে, লেনিন, স্তালিন বা মাও জে দঙের মতো ‘মার্ক্সীয় নায়ক’রা আর লোক টানতে পারছেন না বলেই সিপিএমকে এখন খ্রিস্টের শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। চার্চের ওই অংশের মতে, ধর্মের প্রতি সিপিএমের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর কোনও ইঙ্গিত যদি এর মধ্যে থেকে থাকে, তবে তা স্বাগত। কিন্তু শুধুই সাময়িক রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টা চালানো হয়ে থাকলে তা সফল হবে না।
মওকা বুঝে আসরে নেমে পড়েছে প্রধান শাসক দল কংগ্রেস। কেরল প্রদেশ সভাপতি রমেশ চেন্নিথালার অভিযোগ, দলীয় প্রদর্শনীতে যিশুকে এনে খ্রিস্টানদের ভাবাবেগে ‘আঘাত’ দিয়েছে সিপিএম। বিতর্কের মুখে সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব রাতারাতি যিশুর মধ্যে ‘পীড়িতদের ত্রাতা’র ভাবমূর্তি আবিষ্কার করেছেন! কেরল রাজ্য সম্পাদক, সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য পিনারাই বিজয়ন যেমন তিরুঅনন্তপুরমে ব্যাখ্যা দেন, ‘‘গরিবের শোষণ ও পীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যিশুর অনুগামীদের সঙ্গে কমিউনিস্টদের বিশেষ তফাত নেই!”
নাটক, চলচ্চিত্র, বই-উৎসব, ছবি (ফোটো) প্রদর্শনী নিয়ে ‘প্রতিভা বন্দনম’ নামে বাকি সাংস্কৃতিক উৎসব ঘিরে এখনও বিতর্ক নেই। যেমন নেই খেলার আসর নিয়েও। পালোড জংশন, আট্টিঙ্গল কেসিআরটিসি জংশন, কাঝাকুট্টাম, পালায়ম, মাডাভুরের মতো তিরুঅনন্তপুরমের নানা প্রান্তে এখন চলছে মিনি ম্যারাথন, বক্সিং, ফেন্সিং, কলারিপ্পায়াট্টু (মার্শাল আর্ট) বা নারকেল গাছে চড়ার রমরমা প্রতিযোগিতা! সেন্ট্রাল স্টেডিয়ামে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। জোনাল কমিটি এলাকার ১৮টি দলের পাশাপাশি শহরের প্রেস ক্লাবকে সেখানে টিম নামানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে! ফুটবলে জোনাল থেকে ১৮টি টিম। দুই টুর্নামেন্টেই বিজয়ীর পুরস্কার ১০ হাজার টাকা করে। তার পরেই সব চেয়ে মহার্ঘ প্রতিযোগিতা মিনি ম্যারাথন। সেখানে পুরুষ বিভাগে ১০ হাজার ও মহিলা বিভাগে ৫ হাজার টাকা প্রথম পুরস্কার। কমিউনিস্ট আসরে পুরুষ এবং মহিলার স্বীকৃতিতে ‘বৈষম্য’ কেন, তা নিয়ে অবশ্য কেউ প্রশ্ন তোলেনি!
বিতর্ক হলেও দক্ষিণী রাজ্য ছক ভাঙার চেষ্টা চালিয়েছে। বঙ্গ সিপিএম সেই রাস্তায় হাঁটার কথা ভাবেনি। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেবের কথায়, “রাজ্য সম্মেলন উপলক্ষে ১৫-১৮ ফেব্রুয়ারি কলেজ স্কোয়ার, রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ, মেট্রো চ্যানেলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। মৌলালিতে আলোচনা চক্র থাকছে।” যা প্রতি বারই থাকে।
এ কে জি সেন্টার পারলেও আলিমুদ্দিনের ‘ঝুঁকি’তে সম্ভবত ভয়।
|