পচা বাড়ি যা
গোয়ালঘরের বাঁ দিক ঘেঁষে দু’হাত এগিয়ে পচা দাস সন্তর্পণে পা ফেলল বিচালির গাদার ডাইনে।
নবা কলুর রাত জাগার অভ্যাস। না, অনিদ্রার ব্যামো নয়। সারা দিনের কাজের হিসাব মেলাতে তাকে রাত একটা-দুটো অবধি হামেশাই জাগতে হয়। যে দিন জমার খাতে বাড়াবাড়ি রকমের কিছু ঘটে, সেদিন রাত তিনটেও বেজে যায়। আর এই রাত তিনটেই হল পচা দাসের কাজের সময়।
নবা কলুর তেজারতির কারবার। আর পচা দাসের? থাক, না বলাই ভাল। পচার লাইনে এখন বিস্তর কম্পিটিশন। সে ক’দিন ধরেই ভাবছিল একটা পুরনো প্রবাদ বাক্যের কথা। ‘মারিত গণ্ডার লুটিত ভাণ্ডার।’ তার কাছে পাকা খবর ছিল নবা কলুর বিষয়ে। লোকটা টাকা দিয়ে সোনা কিনে সেগুলো বাট বানিয়ে মাটির তলায় ঢুকিয়ে রাখে। নবা কলুর সোনার বাট নাকি পাতালে গিয়ে ঠেকেছে।
গত দিন পনেরো নাগাড়ে বৃষ্টির জন্য পচার কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটেছে। ঠিকমত হাঁড়ি চড়েনি। তাই আজ সে বদ্ধপরিকর, একটা বড় দাঁও মেরে তার জীবিকা বদলে ফেলবে। এ লাইনে প্রেস্টিজ নেই। লোকে চোর-ছ্যাঁচোড় বলে। ভদ্রলোক হতেই হবে। আর ভদ্রলোক হওয়ার একমাত্র উপায়, বড় ধরনের চুরি করা। নবা কলুর বাড়ির কাজটায় ঝুঁকি আছে, পচা খুব ভাল মতো জানে। তবে এটাও সে জানে, নো রিস্ক নো গেন। পচা ইংরিজি একেবারে বোঝে না, তা নয়। যে ইংরিজি বোঝে সে ঝুঁকিও নিতে পারে। ইংরেজরা সাগর ডিঙিয়ে এত দূর এসেছিল এমনি এমনি নাকি?
একটা জানলার শিক বাঁকিয়ে ফেলা কী ব্রিটিশ আমলের তালা খোলা পচার কাছে নস্যি। সমস্যা ওটা নয়। কথাটা হল পচার দু’দিন ধরে খুক খুক করে কাশি হচ্ছে। আদা, তুলসীপাতা খেয়েও পুরোপুরি বশে আসেনি। পচার হাতের কাজ মাখনের মতো যখন, তবে এই কাশিটা এক বালতি দুধে এক ফোঁটা গো-চোনার মতো।
কাশিটাকে বাগে আনার জন্য পচা দু’দণ্ড ভাটাম গাছটার তলায় দম চেপে বসল। এমন সময় নাকিসুরে একটা সরু কণ্ঠস্বর তার কানে প্রবেশ করল পচা বাড়ি যা।
কে বলল কথটা?
চার পাশে তাকিয়ে দেখল পচা। কাউকে দেখতে না পেয়ে ভাবল, মনের ভুল নাকি? কার এত বড় আস্পর্দা যে, তাকে প্যাঁক মারে? কেউ খেলায় হেরে গেলে তাকে ব্যাঙ্গার্থে বলা হয় ‘বাড়ি যা’। কার ঘাড়ে ক’টা মাথা যে, পচাকে বিদ্রুপ করে! ‘চেপে যা পচা’ বললেও না হয় মানা যেত লোকটা পচাকে কেটে পড়তে বলছে। কিন্তু এ নিশ্চয় আড়কাঠি। কেউ লাগিয়ে রেখেছে পচার পিছনে। সব লাইনেই চোরাগোপ্তা লড়াই আছে। সে দিনমানেই হোক কী রাতবিরেতে। খানিক ক্ষণ থম মেরে বসে রইল পচা। হাবিজাবি ভাবল অনেক কিছু। তার পর মনোসংযোগ করল নবা কলুর পশ্চিমের জানলার দিকে। কাশিটা দমেছে ভেবে উঠে দাঁড়াল পচা। তখন আবার কানে এল আর একটা কথা। ‘কেশো চোর ধরা পড়ে।’ এ বারে পচা নিশ্চিত হল সে ভুল শোনেনি। তবে কণ্ঠস্বরটা সন্দেহজনক। পচা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কে আপনি?’
কোথা থেকে উত্তর ভেসে এল, ‘আজ্ঞে আমি এক জন ব্যর্থ ভূত।’
পচা বলল, ইয়ার্কি মারার আর জায়গা পাননি? ভূত বললেই হল? প্রমাণ করতে পারবেন আপনি ব্যর্থ কিংবা ভূত?
পচা বুঝল টেনশনের মাথায় প্রশ্নটা উল্টোপাল্টা হয়ে গেল বোধ হয়।
ভূতটা সবিনয়ে বলল, ‘আজ্ঞে পারব।’
পচা বলল, ‘আপনি কোথা থেকে কথা বলছেন বলুন তো?’
ভূতটা বলল, ‘আপনার মাথার ওপর ভাটাম গাছের মগডাল থেকে।’
তা আপনি নিজেকে ব্যর্থ বলছেন কেন?
ভূতটা বলল, ‘সব বলব, আগে কথা দিন আমায় দেখে ভয় পাবেন না।’
পচা দোনামোনা করে বলেই ফেলল, ‘আচ্ছা, ভয় পাব না, কথা দিচ্ছি, প্রমিস।’
সড়াৎ করে ভূতটা উঁচু একটা ডাল থেকে নেমে এল। শব্দ শোনাই সার। পচা ভূতটাকে ভাল দেখতে পেল না। ভূতটা দেঁতো হাসি দিয়ে বলল, ‘নমস্কার সার!’
পচা বলল, অন্ধকারে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না আপনার রূপ-গুণ। শুধু একসারি দাঁত দেখা গেল বিদ্যুৎ চমকের মতো। তবে চামচিকের মতো একটা চিমসে গন্ধ পাচ্ছি।’
ভূতটা বলল, ‘বেশ! পাচ্ছেন তো? ওটাই হল আমার ট্রেড মার্ক। গন্ধ আর শব্দ দুটো জিনিস পাচ্ছেন। স্পর্শ করে দেখাব নাকি একটু?’
ভয়ে আঁতকে উঠে পড়া বলল, না, না, থাক।
ভূতটা বলল, ‘ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন, আমার কিন্তু চুলকানি নেই যে, ছুঁলে আপনার গায়ে গজাবে।’
পচা বলল, ‘তবু সাবধানের মার নেই।’
ভূত বলল, ‘তা হলে মেনে নিচ্ছেন আমি ভূত?’
পচা দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, ‘নিচ্ছি।’
ভূতটা বলল, ‘ভাল, ভাল! ভগবান আর ভূতে দুটোকেই মেনে নেওয়া ভাল। দুটোই প্রায় একই জাতের জিনিস, বুঝলেন কি না। একটা যদি রসগোল্লা হয়, তবে অপরটা পান্তুয়া। সরেস জিনিস। তার পর ধরুন, তাঁকে ডেকে ডেকে মুখে ফেকো পড়ে যাবে, তবু তাঁর দেখা পাবেন না। ফুল গ্যারান্টি, পাকা রসিদ। যেমন ধরুন, আমাকেও দেখতে পাচ্ছেন না, কেমন কি না। বোঝাতে পারলাম?
পারলেন। বলে যান।
বেশ, বেশ! তা ভয়টয় আর লাগছে না তো?
আমি তো চোখ বুজে তাঁর নাম করছি।
খুব ভাল! এই সুবাদে আপনার খানিক ধর্মসঞ্চয় হয়ে গেল। দেখেন, একেই বলে সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।
তা নামের গুণে যে শুনেছিলাম ভূত পালায়। কিন্তু আপনি যে বহাল তবিয়তে রয়েছেন দেখছি।
তা হলে আপনার নামে নির্ঘাৎ ভেজাল আছে। ভাল করে ভেবে দেখেন।
ভেজাল?
আপনি কি একই সঙ্গে অন্য কিছু চিন্তা কচ্ছেন?
তা করছি বোধ হয়।
সত্যি করে বলেন তো
সেটা কি?
সোনার বাট।
অ্যাই, কাম টু দ্য পয়েন্ট।
কিন্তু আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?
জানব না? আপনি হলেন স্বনামধন্য পচা দাস। স্টার ফেভার করলে আপনিও খেল দেখাতে পারতেন, সবাই জানে। আপনি দেশের কাজ না করে ভুল জায়গায় মেহনত খাটাচ্ছেন, এ নিয়ে আমরা আপনার গুণমুগ্ধ ভক্তরা কম কথা চালাচালি করেছি নাকি?
তা আমিও কি আপনার নাম জানি?
না জানাটাই স্বাভাবিক। এই লাইনে আমি নভিশ। ততটা নামযশ, আয়পয় হওয়ার আগেই তো নাকে তুলোর পুঁটুলি গুঁজে দিল।
বুঝলাম না, খুলে বলুন।
ভূতটা বলল, ‘নিজেকে কেন ব্যর্থ বলছি জানতে চাইছিলেন না?’
পচা বলল, হ্যাঁ।
‘তবে শুনুন আমার জীবনের করুণ কাহিনি।’ বলতে শুরু করল ভূতটা। ‘আমি হলাম বদন শীল। হলাম মানে ছিলাম। পাস্ট টেন্স। মানুষের মধ্যে যেমন সফল আর ব্যর্থ আছে, ভূতেদের মধ্যেও সেই একই ভেদাভেদ। সফল ভূতেদের সবাই খাতির তোয়াজ করে, ব্যর্থ ভূতেদের গালমন্দ আর দূরছাই করে। আমার বাবা ছিলেন পৃথিবীর শেষ বোকা লোক। আমার জন্য শুধু দুটো হুঁকো রেখে গিয়েছিলেন। ওই হুঁকো দুটোই হল কাল। মনের সুখে টানতে গিয়ে গলায় ধোঁয়া আটকে আমি পটল তুললাম। একদম শর্টকাট রাস্তায় ভূতেদের মুলুকে গিয়ে পৌঁছলাম। সে দিন ভূতেদের রাস্তা অবরোধ চলছিল। একটা পোড়ো বাড়ি ভেঙে ফেলার প্রতিবাদে। আমাকে হাতের নাগালে পেয়ে সবাই ঘিরে ধরে বলল, ‘যদি অম্লান বদনে মিথ্যা বলতে পারার যোগ্যতা থাকে, তবে তোমার একটা চাকরি হবে। মাইনে হিসেবে এক পেটি শুটকি মাছ বরাদ্দ। আমরা এক জন নেতা খুঁজছি।’ ওরা আমাকে তিনটে প্রশ্ন করল। বাবার নাম কী, বয়স কত, ইলেকশনে জিতলে দেশের জন্য কী কী করবেন? মাগ্গি গণ্ডার বাজারে একটা চাকরি পাওয়া মুখের কথা নাকি? জীবিত অবস্থায় চাকরি জোটেনি, কিন্তু মরে গিয়ে আমার ভাগ্য খুলে গেল। একটা নামজাদা লোককে নিজের বাবা বলে চালিয়ে দিলাম। বয়স ভাঁড়িয়ে বললাম। আর দেশের জন্য ভোটের আগে যা যা বলা দস্তুর, সে সব বহু বার শুনে শুনে মুখস্থই ছিল, কপচে দিলাম। চাকরিটা হল। কিন্তু এক দিন কালের নিয়মে আমার মুখ ফস্কে একটা সত্যি কথা বেরিয়ে গেল। ব্যস, চাকরি নট।’
ভূতটাকে চুপ করে যেতে দেখে পচা বলল, সত্যি কথাটা কী?
বদন শীল বলল, ‘প্রশ্নটা হল, চোরের সাত দিন, গৃহস্থের এক দিন’ কথাটার সারবত্তা আছে কি? এক কথায় উত্তর দিন।
পচা ভয়ে ভয়ে বলল, উত্তরটা কী হবে?
বদন শীল বলল, ‘উত্তরটা আপনি ধরেই ফেলেছেন। তাই বলছিলাম, পচা বাড়ি যা। নবা কলু একটা নতুন পিস্তল কিনেছে। আর মহা উৎসাহে ঘর অন্ধকার করে বসে আছে জেগে। যদি গুলি খাওয়াবার আর একটা খদ্দের জোটে।’
পচা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, মহা উপকার করলেন আমার। আপনি ভূত নন, মহাপুরুষ। আমার প্রণাম নিন। সোনাদানার চে প্রাণের দাম নিশ্চয় বেশি। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে নবা কলু পিস্তল কিনেছে?
বদন শীল বলল, ‘জানব না? প্রথম গুলিটা তো আমিই খেয়েছি। হুঁকোর গল্পটা নেহাত শিল্পের খাতিরে বানানো।’

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.