|
|
|
|
ফের পাতার অপেক্ষায় |
প্রাণপণ চেপে ধরা সত্ত্বেও, মনে দাগা দিয়ে খসে যায় পুরনো পাতার দল, আর বসন্তের গোড়ায় আবার
টুক করে খেলায় মেতে ওঠে নতুন ঝাঁক। এমনকী মনের কোনও কোনও শীত-বসন্তেও। অমিতাভ মালাকার |
সেই বছর বসন্তের গোড়ায় বড়দের কাঁধে আলগোছে এক পোঁচ আলোয়ান বা চাদর তখনও দেখা গেলেও, আমরা ফুটবল খেলা সেরে বাড়ি ফিরতাম পুরোদস্তুর ঘেমে-নেয়ে। এক দিন শুনলাম নির্মল কাকার ভায়রাভাই বেড়াতে এসে রোদে পিঠ দিয়ে বসে মোটা একখানা বইয়ের ফাঁকে চশমা গুঁজে রেখে ভুরু কুঁচকে রমেনকে বলেছেন, তুমি তো দেখছি ছোকরা ভারী বেয়াদপ আর স্কেপটিক। ব্যস, আর যায় কোথায়! পাড়াময় রাষ্ট্র হয়ে গেল ডাক্তারবাবুর আত্মীয় পাড়ার বাচ্চাদের সেপটিক দিয়ে মেরে ফেলবার প্ল্যান করছেন বাচ্চা বলতে রমেন ভার্টিকালি চ্যালেঞ্জড হওয়ার কারণে পুরনো হারকিউলিস সাইকেলে হাফ প্যাড্ল মেরে চা বাগানের বাবু লাইনে সন্ধের পর মিতালির সঙ্গে প্রেম করতে যেত।
সে যাক। বৃদ্ধ হেডমাস্টারমশাইয়ের সে কী রাগারাগি ভায়রাটির ওপর। তিনি কেবল ঢোক গেলেন, আরে, কী আপদ, আমি কেন ওকে মারতে যাব? হেডমাস্টারমশাই খালি থরথর করে কাঁপেন আর বলেন তা হলে তড়পাতে গেছিলে কেন? সৎসাহসের জোরে বলিষ্ঠ চিত্তে যা করতে পারবে না, তা নিয়ে আস্ফালন করতে নেই জানো না? আমাদের সময়টাই ছিল সে রকম। তার মধ্যে কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ কী করে যেন একটু বড় হয়ে গেলাম। পাতা খসানোর সময় হয়েছে শুরু, এ খবর আঁচ করতে পেরে, আমলকী বনের বুক কেমন দুরুদুরু কেঁপে উঠেছিল, রবিবাবুর সে কাহিনি আমরা যে ভাবে গড়গড় করে আবৃত্তি করতে অভ্যস্ত ছিলাম, সেই সাবলীল স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে কোথায় যেন একটা ভয়ের রেশ মাথা ছাড়িয়ে অনেক ওপরে, বাসায় ফেরা পাখিদের ঘুরপাক খেয়ে ওড়াউড়ির আরও অনেক অনেক দূরে আকাশের গায়ে ঠায় দাঁড়ানোর পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছিল সকলের অজান্তেই। |
|
হয়তো সে অপেক্ষার শুরু সৃষ্টির এক্বেবারে গোড়ায়, তবে এখন সে মাঝে মধ্যে লম্বা হাতখান বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিয়ে যায় মাত্র আমাকে ছোঁয়, আর কেবল আমার গায়েই এমন ভাবে হাত রাখে যে পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে, দিন, দুপুর, সন্ধেগুলো ছোটাছুটি করে অবসাদ আর নাম-না-জানা তীব্র উৎসাহ আকাঙ্ক্ষার ভিতর। সে স্পর্শজনিত ভয়ের অনেকটাই অনাস্বাদিত লোভী-মুখ মিষ্টি লালায় ভরে ওঠার স্বাদে আর গায়ে কাঁটা দেওয়ার শিরশিরানির আনন্দে ভরপুর। মনে হত গোটা পৃথিবী জুড়ে হায় রে, সেই পৃথিবীর বিস্তার ওই রেল লাইনের ও ধারে কলোনি আর এ ধারে ঝাপসা নীল পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে ফিরে আসে চেনা এক স্থায়ী সন্ধে নামুক। সে সন্ধ্যাকাশের রং হবে আমার পছন্দ মাফিক, মেঘের ফাঁক দিয়ে এক চিলতে আলো কোন বাড়ির ছাদে, কার মেলে দেওয়া কাপড় তুলতে আসার সময়টাকে রাঙিয়ে দিয়ে যাবে, সে-ও আমার ভাবা হয়ে গিয়েছে। সাইকেল সারাইয়ের দোকানে রেডিয়োতে কী গান বাজবে ফৌজি ভাইদের জন্য, সে তালিকাও প্রস্তুত। আমি জানতে শুরু করেছি ওই গানের কথা, সুর পেরিয়ে আরও নানা মানে তৈরি করে নেওয়ার জন্য আমি আগাপাছতলা নিজেকে সাজিয়ে নিতে না পারলেও, টুকরো কথা, সুর, পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান-এর বাজনা একে অপরের ভেতর ঢুকে আগামী কয়েকটা দিন আমার মগজে লেপ্টে থাকবেই। তাদের ফিরে আসা মানে সেই সন্ধেগুলোও ফিরে আসবে। কোনও নির্দিষ্ট গানের খেই ধরে নয়, আবার তেমনটা হলেও ক্ষতি নেই। তবু বাস ধরে ইস্কুলে যাওয়ার জন্য যে নতুন লালচে নরম পাতা গজানো গাছটার তলায় সকালের তেরছা আলোয় আগে বরাবর এমনিই দাঁড়াতাম বেখেয়ালের বশে, সেখানে পৌঁছনোর জন্য কেমন একটা আনচান করত গোটা শরীর। ওইটুকুই ফিরে ফিরে আসুক তবে।
ওপরের দিকে তাকালে ন্যাড়া গাছগুলোর ডালে সবজেটে ছোপ হঠাৎ এক দিন সকালে দেখি বড় পাতায় রূপান্তরিত হয়েছে, কখন কে জানে! দখিনা বাতাসে তাদের দিব্বি ফুরফুরে মাথা দোলানো। হেমন্তের গোড়ায় হাড়ে কাঁপুনি ধরানো শন শন আওয়াজের বদলে মাঝে মাঝে গরম হাওয়ার দমকা গালে-ঘাড়ে-হাতের তালুতে ভালই লাগে। শুকনো নদীর চড়ায় বালি ওড়ে সারা দিন। এ ধার থেকে ও ধার, ও ধার থেকে এ ধার। দূরে কোথাও বৃষ্টি নামবে শিগগিরি। শাল বনের তলায় বিছিয়ে থাকা পাতার স্তূপ ভিজে ফুলে উঠবে গোড়ায়। তার পর মাটিতে পুরোপুরি মিশে যাওয়ার আগেই সে আস্তরণ ফুঁড়ে বেরোবে কচি সবুজ পাতা। প্রত্যেকটা পাতার গড়ন আলাদা, এক এক রকমের সবুজ রাঙানো তারা। কোনওটার ওপর একটা কালো পিঁপড়ে একেবারেই উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি করে কাটিয়ে দেয় গোটা দিন। কেন কে জানে! কোনওটা গোড়া থেকেই নদীর জলের ওপর ঝুঁকে থাকে, ওল্টানো আকাশের দিকে মুখ বাড়িয়ে, ওল্টানো সন্ধে উল্টে-পাল্টে যাওয়া রাতের আকাশের দিকে মাথা উঁচিয়ে যেন আবার এই পৃথিবীর ভেতর ফিরে যেতে চায়। |
ছবি: সুমন চৌধুরী |
|
|
|
|
|