মাটির মানুষ
নদিয়ার অশীতিপর চন্দ্রকান্ত
এখনও জাদু দেখান শ্রীখোলে
য়টি দশক ধরে শ্রীখোলে হাতের জাদু দেখিয়েছেন। এখন হাজারো আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের ভিড়ে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে কেউ কেউ এখনও তাঁর কদর বোঝেন। যাঁরা ‘জাত’ কীর্তনীয়া। সমঝদার তাঁর শ্রীখোলের। যাঁরা আসর করেন পদাবলি কীর্তনের। যাঁরা মহাজনি পদ গাইতে জানেন ও চান, সেখানেই ডাক পড়ে নব্বই ছুঁতে চলা এই শ্রীখোল বাদকের। নদিয়ার প্রাচীন মায়াপুরের চন্দ্রকান্ত কংসবণিকের।
কীর্তনের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেতছ গিয়ে খেদোক্তি ঝরে পড়ে প্রবীণ শিল্পীর গলায়, “প্রাচীন কীর্তনের ধারা প্রায় শেষ। নবদ্বীপের শেষ সম্বল ওই সরস্বতী। ওঁর সঙ্গেও অনেক আসর করেছি। বাজিয়েছি। আশা ছিল শিষ্য গড়ব। বাজন-ঘরানা দিয়ে যাব ছাত্রদের। তা আর হল কই? সবই মহাপ্রভুর ইচ্ছা।” কপালে ছোঁয়ালেন করজোড়। নবদ্বীপের নতুনপাড়ার দারিদ্রে মোড়া ঘরে চারপাইয়ে বসে আঠাশ মাত্রার সোমতাল বাজালেন। ‘তাল’, ‘লয়’-এর ব্যাখ্যা দিলেন। বোঝালেন রাগাশ্রিত কীর্তন শুরু হয় কেমন করে। ধীর থেকে দ্রুত লয়ের গতিপ্রকৃতি। দীর্ঘ ভাষণের পড়ে শিল্পীর কণ্ঠস্বর কিছুটা ক্লান্ত। মেঝেতে বসে পুত্র তৈরি করে চলেছেন তিলক সরূপের পিতলের কাঠি, তিলক আঁকার জন্য। পিতা-পুত্রের এমন অভাবী সংসারে, এতদিনের শ্রীখোলের ‘তালজ্ঞান’ বুঝি অস্তাচলে। প্রাচীন এই তালজ্ঞান গ্রহণ করার জন্য বুঝি কেউ নেই।
নিজস্ব চিত্র।
পদবি ‘কংসবণিক’। অর্থাৎ সামাজিক ‘থাক’-এ এঁরা হলেন কাঁসারি। পিতল-কাঁসার কারিগর। কিন্তু শ্রীচৈতন্যের ধর্মীয় আদর্শে সমাজের জাত-পাত-থাক ভেঙে যেমন সকলকে ডাক দিয়েছিলেন কৃষ্ণনামে। তেমনই গানের সঙ্গে যন্ত্রী যাঁরা এসে যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের জাতিগত সমস্যা ছিল না। চন্দ্রকান্তের পূর্বপুরুষের নিবাস পূর্ববাংলার মাদারিপুরের বাঘিয়া গ্রাম। দেশ ভাগের তিন মাস পরে, মা-বাবা হরিপদ ও হারানির সঙ্গে রানাঘাটের উদ্বাস্তু ক্যাম্পে ঠাঁই। সেখান থেকে প্রাচীন মায়াপুরের নতুনপাড়ার সপ্তম লেন। তারপর থেকে এটাই ঘর।
তালবাদ্য শিক্ষার ইতিহাস শোনালেন চন্দ্রকান্ত, “কৈশোরে শ্রীখোলের পাঠ পূর্ব বাংলার জগবন্ধু কংসবণিকের কাছে। উনিশ বছর বয়সে খোল ভালভাবে শিখব বলে রানাঘাটের আত্মীয় বাড়িতে চলে এলাম। গোরাচাঁদের আখড়ায় বিখ্যাত শ্রীখোল বাদক গৌরদাস মহন্তের কাছে নাড়া বাঁধা। এর পরে পারিবারিক কারণে আবার চলে গেলাম বাংলাদেশে। যতদূর মনে পড়ে, আমাদের ছিল ষোলো পুরুষের কাঁসারির কাজ। আমিই পরিবারের প্রথম খোল বাদক।”
ধাতুশিল্পের তৈজসপত্রের কারিগর ও ব্যবসা থেকে একেবারে বিপরীত মেরুতে অভিযানের রহস্য? চন্দ্রকান্ত যে তথ্য দিলেন তাতে জানা গেল, মাদারিপুরের পুরাতন বাজারে বিখ্যাত মৃদঙ্গ বাদক, সনাতন সাহার কাছেও বাজন শিখেছেন। স্বামী স্বরূপানন্দের সঙ্গে শ্রীখোল কাঁধে দীর্ঘ সময় ধরে অসম ভ্রমণ। গোরক্ষপুরের গীতাপ্রেসের অনুষ্ঠানে খোল বাজানোর স্মৃতি এখনও টগবগে। এক সময়ে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীতের ক্লাসে সনাতন সাহার ক্লাসে শ্রীখোল বাজিয়েছেন। কীর্তন জগতের বিখ্যাত মানুষ রাধারমণ কর্মকার, শোভনা চৌধুরী, রথীন ঘোষ ও নবদ্বীপের রাধাচরণ বাবাজির সঙ্গে সঙ্গতের স্মৃতি অমূল্য সম্পদ।
মাটির শ্রীখোল আজকে যতটা ব্যবহৃত হয় তার চেয়ে বেশি ব্যবহার হয় কাঠের শ্রীখোল। তবে আধুনিকতার দাবিতে এ সব প্রায় সরে গিয়ে চলে এসেছে পিতলের খোল। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাজির ফাইবারের খোল।
তবে চন্দ্রকান্তের কথায়, “বোলের স্বচ্ছন্দ বিচরণ মাটি ও কাঠের শ্রীখোলেই।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.