|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
মুক্ত চিন্তা, ফিরে পাওয়া |
|
সাগরময় |
আড়ালে থাকাটাও যে সম্পাদনার সংস্কৃতি, সে কথাটা বার বার প্রমাণ করে গিয়েছেন সাগরময় ঘোষ। সম্পাদকের ছবি দেওয়া ব্লার্ব, নিজের পত্রিকায় নিজেরই হরেক লেখার ‘সংস্কৃতি’ এখন সুলভ যে-বইপাড়ায় সেখানে সাগরময় ঘোষের রচনাসংগ্রহ (আনন্দ, ৩৫০.০০) ব্যতিক্রমটি সুপ্রতিষ্ঠিত করল। ‘দেশ’ পত্রিকার দীর্ঘ সময়ের সম্পাদক সাগরময় নিজে লেখালেখি করেননি বিশেষ। বিধানচন্দ্র রায়ের জীবনী একটি পেরেকের কাহিনী, সম্পাদক-জীবনের স্মৃতিকথা সম্পাদকের বৈঠকে, হীরের নাকছাবি, ছোটদের জন্য দণ্ডকারণ্যের বাঘ এইমাত্রেই শেষ তাঁর রচনাসংগ্রহ। তাঁর শতবর্ষে দু মলাটে পাওয়া গেল সেই সংগ্রহ। একটি মূল্যবান প্রাপ্তি। |
|
|
‘আর্থার সি ক্লার্কের সঙ্গে যখন আমেরিকান দূতাবাসে আলাপ হয়েছিল, প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, ...কেন আপনি সায়ান্স-ফিকশন লেখা শুরু করলেন? উনি জবাবটা দিলেন খুব ছোট্ট: টু ইন্সপায়ার।’ বিশ্বসেরা সায়ান্স ফিকশান-এর (দে’জ, ৩৫০.০০) ব্লার্বে লিখেছেন অনুবাদক অদ্রীশ বর্ধন। ‘কল্পবিজ্ঞান’ প্রতিশব্দটির উদ্ভাবক, গোয়েন্দা কাহিনি আর সায়ান্স ফিকশনের সাড়া জাগানো অনুবাদক ধারাবাহিক অনুবাদ করেছেন কথাসরিৎসাগরেরও। তারই ফসল তাঁর পুনঃকথনে কথাসরিৎসাগর (পারুল, ৩৯৫.০০)। মোট ১২৪টি গল্প, মূলের ক্রমে সাজানো। আছে বেশ কয়েকটি অলংকরণও।
প্রখ্যাত অর্থনীতি-সংস্কৃতি-সমাজতত্ত্ববিদ অশোক সেনের প্রবন্ধ সংকলন ইতিহাসের ঠিকঠিকানা (সেরিবান, ২০০.০০)। যে সময় কাল ধরে এই প্রবন্ধগুলি লেখা সেটা সোভিয়েত রাশিয়ার পতন, চিনের বাজার অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে ধনতন্ত্রের দুনিয়াজোড়া সংকট আর আমাদের চারপাশে নন্দীগ্রাম আর সিঙ্গুরের অভিজ্ঞতা পর্যন্ত বিস্তৃত। এটাই আবার নানান কিসিমের ‘মার্কসবাদী’দের ডিঙিয়ে স্বয়ং মার্কসকে আর এক বার নতুন করে চেনার সময়। এই বইটি সেই আলোচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। বাড়তি পাওনা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক দীর্ঘ সংলাপ।
বিভিন্ন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ অজস্র বাণী লিখে গিয়েছেন। একবাক্য থেকে দীর্ঘ পদ্য রকমারি তার শৈলী। সেগুলি একসঙ্গে করেছেন উজ্জ্বলকুমার দে। বইয়ের নাম রবীন্দ্র বাণী (পুস্তক বিপণি, ১৫০.০০)। নিতান্ত মামুলি বিজ্ঞাপনী বাক্যেও মাঝে মধ্যে স্বকীয়তা ঝলসে ওঠে। যেমন, ‘কাজল কালী ব্যবহার করে সন্তোষ লাভ করেছি। এর কালিমা বিদেশী কালীর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।’
দেবাশিস বিশ্বাসের নেশা পবর্তারোহণ। অনেকটা ডায়েরি লেখার মতো করে, তাঁর এভারেস্ট বিজয়ের গল্প শুনিয়েছেন এভারেস্ট শীর্ষে বাঙালি বইটিতে (আনন্দ, ২০০.০০)। অভিযাত্রী জীবনের ঘটনাবহুল প্রতি দিনের সঙ্গেই মিশে রয়েছে যাত্রাপথের ইতিহাস। দুর্গম অঞ্চলটির কিছু মানচিত্র আর বেস ক্যাম্প-শীর্ষের রঙিন আলোকচিত্র, আখ্যানটিকে বেশ জীবন্ত করে তুলেছে। লেখক পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ইয়েলো ব্যান্ড, ডেথ জোন প্রভৃতি বেশ কিছু পাহাড়ি শব্দের সঙ্গে।
‘কোয়েস্ট’ পত্রিকার সম্পাদক জি আর এস মিড ১৯১৩ সালে লন্ডনের ক্যাক্সটন হল-এ রবীন্দ্রনাথের এক বক্তৃতামালার আয়োজন করেছিলেন। সেগুলি পরে ‘সাধনা: দ্য রিয়ালাইজেশন অব লাইফ’ নামে সঙ্কলিত হয়। রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন, বিশেষত তাঁর উপনিষদ-চিন্তার একটি মূল্যবান আকর এই বক্তৃতাগুলি। কমলিকা রায়ের রবীন্দ্রনাথের সাধনা বক্তৃতামালা (কারিগর, ২৫০.০০) মূলত ভাবানুবাদ, কিছু আলোচনা সহ। সুদৃশ্য বইটির ব্লার্ব-এর শুরুতেই ‘ভাসণ’ বড় বেশি ধাক্কা দেয়, বিশেষ করে প্রকাশকরা যখন জানান যে, ‘বাংলা প্রকাশনা জগতে এল এক নতুন নাম, নতুনের সম্ভাবনা।’
প্রয়াত প্রাবন্ধিক ও গ্রন্থাগারিক চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিদেশি কলম (মিত্র ও ঘোষ, ১২০.০০) সারা দুনিয়ার স্মরণীয় ঔপন্যাসিক, কবি, নাট্যকারদের জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে আলোচনার সমাহার। সফোক্লেস থেকে শেক্সপিয়র থেকে ব্রেখট অবধি অনেকেই এসেছেন তাঁর আলোচনায়। ভূমিকায় অরুণ বসু জানিয়েছেন ‘বিশ্বসাহিত্যের সকল রাজ্যের রাজধানী পর্যটনের এই অনায়াস অধিকার মনীষার জগতে একালেও দুর্লভ। এই দুর্লভ গুণের অধিকারী ছিলেন চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯১৫-২০১০)।’
‘গীতাঞ্জলি-র ৫৩, গীতিমাল্য-র ১৫, নৈবেদ্য-র ১৭ (দুটি সনেট মিলে অনুবাদে একটি), খেয়া-র ১১, শিশু-র ৩ আর কল্পনা চৈতালি স্মরণ উৎসর্গ অচলায়তন-এর একটি করে নিয়ে Gitanjali, মোট রচনা সংখ্যা ১০৩।’ প্রণতি মুখোপাধ্যায় ‘Gitanjali Song Offerings’-এর হয়ে ওঠার একটি চমৎকার দলিল তৈরি করেছেন। ইংরেজি গীতাঞ্জলি প্রকাশের (নভেম্বর ১৯১২) শতবর্ষের পূর্বলগ্নে কবি এক জাগে (পুনশ্চ, ৭৯৫.০০), এক কথায় বললে, একটা কাজের কাজ।
‘একজন বলয়বিক্রেতা দোকানদার গরম গরম কচুরী খাইতেছিল; তাহারি সম্মুখে, একজন রমণী রমণীর কঙ্কাল বলিলেও হয় যাচ্ঞার ভাবে সেইখানে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার শুষ্ক স্তনের উপর, তাহার বুকের হাড়ের উপর, সে একটি কঙ্কালসার শিশুকে জাপ্টাইয়া ধরিয়া আছে। না, দোকানদার তাহাকে কিছুই দিল না; এমন কি, তাহার দিকে একবার চাহিয়াও দেখিল না।’ পড়লে এক বারও অনুবাদ বলে মনে হয় না। ফরাসি ঔপন্যাসিক তথা নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট পিয়ের লোতি উনিশ শতকের একেবারে শেষে ভারতে এসেছিলেন। তাঁর ভারতভ্রমণের কাহিনি L’Inde (Sans les Anglais) বাংলায় অনুবাদ করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। পুনর্মুদ্রিত হল সেই অসামান্য অনুবাদ ইংরাজ-বর্জ্জিত ভারতবর্ষ (পরশপাথর, ২০০.০০)।
লোকায়ত দর্শনের চর্চায় পুরোধা-পণ্ডিত দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের অগ্রন্থিত লেখার দুটি সঙ্কলন এর আগেই প্রকাশিত হয়েছিল। দর্শন, বিজ্ঞান ও মনস্তত্ত্ব বিষয়ে তাঁর আরও বেশ কিছু লেখা নিয়ে মলয়েন্দু দিন্দার সম্পাদনায় এ বার পাওয়া গেল তৃতীয় খণ্ডের অগ্রন্থিত রচনা (অবভাস, ১৭০.০০)।
শতবর্ষ-পেরনো ‘গীতাঞ্জলি’-র গানগুলির আবেদন আজ সর্বজনীন। গানগুলি নিজেদের অনুভবে জড়িয়ে কী ভাবে শুনছেন সাম্প্রতিক বিশিষ্ট কবিরা, তাঁদের সেই নতুন পাঠ নিয়েই বেরল গীতাঞ্জলি/আমার আপন গান (সম্পা: গৌতম ঘোষদস্তিদার। রক্তমাংস, ১০০.০০)।
ডান পাতায় রেখাচিত্র, মুখ বা পোর্ট্রেট, বাঁ পাতায় সে-মানুষটিকে নিয়েই অল্প শব্দে বোনা কথাচিত্র। হিরণ মিত্রের এক আশ্চর্য সৃষ্টি মুখ-মুখর (ছাতিম বুক্স, ৫৫০.০০)। প্রচ্ছদ থেকে গোটা গ্রন্থের অঙ্গসজ্জা, সবই তাঁর। খ্যাত-অখ্যাত সব ধরনের মানুষকেই রেখাবন্দি-শব্দবন্দি করেছেন হিরণ তাঁদের কথায়, গানে, হাঁটার ফাঁকে ফাঁকে, কিংবা অন্যমনস্কতায়। লেখা-রেখার মধ্যে যে ‘স্পেস’, তাতে না-হলা কথাও যেন উঠে এসেছে অনেকটা। অবশ্য-সংগ্রহযোগ্য।
বাঙালির যৌনতার জরিপ করতে চেয়েছেন সোমব্রত সরকার। সেই প্রাচীন যুগ থেকে পদাবলী-মঙ্গলকাব্য, সামাজিক নকশা, বাংলা গান, বাঙালির চিত্রকলা, বাংলা সিনেমা তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করেই নির্মিত তাঁর যৌনতার রূপ ও রূপান্তর (কারিগর, ৩৫০.০০)। সোমব্রত-র গদ্য আর বইটির নির্মাণে শিল্পিত স্বভাব সংযম প্রশংসনীয়।
ঘুড়ির কাজ কিন্তু শুধুই সারা আকাশ জুড়ে উড়ে বেড়ানো নয়। শত্রুপক্ষকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানো, আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি বুঝতে সাহায্য করা, মানুষ বহন করা কত কাজ ঘুড়ির। ঘুড়ি প্রথম তৈরি হয় চিনে, যিশু খ্রিস্ট-এর জন্মের অনেক আগে। তৈরি করতে ব্যবহার হয়েছিল কাঠ। চিন থেকে ভারতের আকাশে ঘুড়ি ঢুকেছিল বৌদ্ধ ভিক্ষুকদের হাত ধরে। ঘুড়ির এই ইতিহাস থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশে তার রকমভেদ, ঘুড়ি ওড়ানোর কায়দাকানুন সহ নানা মজাদার তথ্যের সঙ্গে ছোটদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন রথীন পাল, তাঁর ঘুড়ির কথা বইতে (আনন্দ, ৩০০.০০)। প্রথমেই নজর কাড়ে এর অভিনব মলাটটি।
স্বপ্নময় চক্রবর্তী তাঁর আলাপ বিলাপ-এর (কোরক, ১০০.০০) প্রারম্ভ কথা-য় লিখেছেন ‘এর একটাও পণ্ডিতি প্রবন্ধ নয়। লেখার জন্য দলিল দস্তাবেজ ঘাঁটিনি। অনুভব এবং প্রতিক্রিয়াই জানিয়েছি।’ তাঁর আলোচনার বিষয়াদির মধ্যে বাঙালি মধ্যবিত্তের ধর্ম, রান্না, অশ্লীলতা, যৌনশিক্ষা অনেক কিছুই ঠাঁই পেয়েছে। বাড়তি পাওনা তাঁর ঔপন্যাসিক কলমের কৌণিক গদ্য।
গত পঞ্চাশ বছরে ছোটবড় পত্রপত্রিকায় বই নিয়ে ছোটবড় মাপের যে সব আলোচনা করেছেন অলোক রায়, তা থেকে বাছাই করেই বেরিয়েছে সাহিত্য একনজরে (কারুকথা, ১০০.০০)। তিনি ভূমিকায় জানিয়েছেন “একে ‘সমালোচনা’ বলে না, ‘গ্রন্থপরিচয়’ বললে বেশি বলা হয়।’’ কিন্তু অনতিদীর্ঘ এই রচনাগুলি কমবেশি নতুন চিন্তা উসকে দেয়।
নতুন সংস্করণে প্রকাশিত হল দীর্ঘ দিন না-ছাপা থাকা অপু ট্রিলজি (রবিন উড, অনুবাদ চিন্ময় গুহ, ১৫০.০০)। সংগ্রহযোগ্য বই, আরও ঝকঝকে চেহারায় ফিরল এই মেলায়।
গোলাপ ফোটানোর আত্মকথন আবদুশ শাকুরের গোলাপনামা (প্রতিভাস, ৬০০.০০)। গোলাপ ও গজল, গোলাপ ও বিপ্লব, গোলাপ নিয়ে নানা সাক্ষাৎকারের সঙ্গে আছে গোলাপরম্যরচনা আর অনেক ছবি।
মাই লাইফ মাই ম্যাজিক (পারুল, ৩৯৫.০০) পি সি সরকার জুনিয়রের জাদুজীবনের আত্মকথন। মূল বাংলা বইটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেশ কিছু ছবি, অনুবাদ করেছেন শ্রীজাতা গুহ।
‘দিদিমা কাগজের ঠোঙা, ঠোঙা বাঁধার সুতলি, সব গুছিয়ে রাখতেন। পরে সেগুলো কাজে লাগবে বলে। বলতেন, যারে রাখো, সেই রাখে।’ মনে রেখেছেন মহাশ্বেতা দেবী, তাঁর স্মৃতিতে শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের পড়াশোনার খবর নিয়েই আমাদের পড়াশোনা (গন্ধর্ব, ৩০.০০)।
কালিন্দী ব্রাত্যজন থেকে বেরিয়েছে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের পল্টুদা বলেন যা (পরি: দীপ, ৫০.০০)। একই প্রকাশনা থেকে থিয়েটারের আলো-মঞ্চ-আবহ-অভিনয় নিয়ে থিয়েটারের হাড়গোড় (পরি: দীপ, ৮০.০০), লিখেছেন দেবাশিস রায়, পৃথ্বীশ রাণা, বিল্বতোষ চট্টোপাধ্যায়, চিত্রাঙ্গদা চক্রবর্তী। শোভন গুপ্তের ব্রডওয়ে থিয়েটার (পরি: দীপ, ৬০.০০)। দীপ থেকেই বেরিয়েছে শোভন গুপ্তের শম্ভু মিত্র: অন্য সন্ধান (৬০.০০)। প্রয়াত রমাপ্রসাদ বণিকের নাট্যসমগ্র ১ (পত্রলেখা, ৩০০.০০) বেরিয়েছে, ভূমিকায় বিভাস চক্রবর্তী লিখেছেন শুধুই আবেগের জোয়ার নয়, বুদ্ধিদীপ্ত এবং সরস সংলাপের দ্যুতি ছিটকে বেরোত তার লেখা থেকে...।’ |
|
|
|
|
|