|
|
|
|
|
|
|
সঙ্গীত সমালোচনা... |
|
বর্ণময় সুর-ঝঙ্কারে |
স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এ বারের ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলন তাঁরই নামে নিবেদিত।
মেতে উঠেছিল চার দিনের ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলন। লিখছেন আশিস চট্টোপাধ্যায় |
স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এ বারের ডোভার লেন সঙ্গীত সম্মেলন তাঁরই নামে নিবেদিত। সম্মেলন এ বছর ষাট বছরে উপনীত। দেশ-এর উজ্জ্বল উপস্থাপনায় সম্পন্ন হল নজরুল মঞ্চে। চার দিনই অধিবেশন ছিল সারা রাতব্যাপী।
প্রতি বছরের মতো এ বারেও সম্মেলনের বৈশিষ্ট্যগুলি যথারীতি উপস্থিত ছিল। যেমন, সম্মাননা জ্ঞাপন এবং নবীন প্রতিভার সন্ধানে প্রতিযোগিতায় কৃতী প্রার্থীদের পুরস্কার অর্পণ। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অবদানের জন্য এ বার সঙ্গীত সম্মানে ভূষিত হলেন গিরিজা দেবী। রৌপ্যস্মারক, শাল, উত্তরীয় দিয়ে সম্মান জানান সম্পাদক বাপ্পা সেন, সভাপতি বি.কে.চন্দ। মানপত্রটি তাঁর হাতে তুলে দেন ভাইস চেয়ারম্যান প্রদীপ্তশংকর সেন। এ বার উদ্যোক্তারা আরও এক জন গুণী কারিগরকে ‘বিশেষ সম্মান’-এ সম্মানিত করেন। তিনি বিরাশি বছরের তানপুরা প্রস্তুতকারক বিমল বিশ্বাস। সম্মেলনের তরফ থেকে নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের উনিশশো আশি সালে বাজানো শ্যামকল্যাণ রাগে একটি সিডি প্রকাশিত হয়। প্রকাশ করেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। প্রদীপ জ্বালিয়ে সম্মেলনের শুভারম্ভ করেন উদ্বোধক জহর সরকার। স্বাগত ভাষণ দেন প্রদীপ্তশংকর সেন। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বাপ্পা সেন।
আলি আহমেদ খানের সানাইয়ের সুরে সম্মেলনের শুভ সূচনা। রাগ কেদার প্রার্থিত সৌন্দর্য নিয়ে উপস্থিত হয় তাঁর পরিবেশনায়। আশের কারুকৃতি দ্রুত তান গমকের ব্যবহার সাবলীল। অনুষ্ঠান শেষ করেন মিশ্র খাম্বাজের একটি বর্ণময় ধুনে। পিতাকে সহযোগিতায় দুই পুত্র যোগ্য উত্তরসূরির স্বাক্ষর রেখেছে। সমর সাহার সুখকর সঙ্গত সমগ্র অনুষ্ঠানটিকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
|
|
রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করে আসর শুরু করলেন
আমজাদ
আলি খান। তিনি শ্রদ্ধার মালাটি গাঁথলেন নানা রাগে.... |
তিন জন ছাত্রীকে নিয়ে মঞ্চে উপবিষ্ট হলেন প্রবীণা গিরিজা দেবী। গাইলেন রাগ যোগ। তাঁর জোয়ারি- ঋদ্ধ কণ্ঠে দুই গান্ধারের মিড়ের প্রয়োগে যোগের রাগরূপ কায়েম হয়ে যায়। মিড় আশের কাজ ও তান তাঁর গায়কির বৈশিষ্ট্য। পরবর্তী নিবেদন বাহার রাগে টপ খেয়াল। ‘এ গুলশন মে বুলবুল’ আদ্ধা তালে নিবদ্ধ। অসাধারণ পরিবেশনা। খেয়ালের পর দেশ রাগে ঠুমরির আমেজ কাটতে না কাটতে খাম্বাজ রাগে একটি হোরী শুনিয়ে তিনি অনুষ্ঠান শেষ করেন। তাঁর তালিমপ্রাপ্ত তিন ছাত্রীই যোগ্য সাহচর্য দিয়েছেন। তবলায় শুভেন চট্টোপাধ্যায়, হারমোনিয়ামে সনাতন গোস্বামী শিল্পীকে স্বস্তিতে রেখেছিলেন।
গানের পর সেতার। শিল্পী সুজাত হোসেন খান। প্রথমেই শুধু তরফের তারে স্বর সংযোজনা দিয়ে যে মূর্ছনার সৃষ্টি করেন মুহূর্তের মধ্যে চার দেয়ালের প্রেক্ষাপটে রাগ ঝিঁঝিটের ছবি ফুটে ওঠে। সুরকে ভিত্তি করে গমক ও আশের কাজ শব্দ নিয়ে নানা নিরীক্ষা দ্রুত দৃপ্ত তানকারি চমক জাগায়। ঝিঁঝিটের পর খাম্বাজ রাগে একটি ধুন ধরেন। নানা লোকসুরের মাধুর্য শ্রোতাদের শ্রুতির বাসনা কানায় কানায় পূর্ণ করে দেয়। অসাধারণ তৈরি হাত। শেষে তিনি গজল থেকে বাংলা গান গেয়ে এবং বাজিয়ে শোনান। সেতারের মতো গানও মন কাড়ে। সঙ্গত সাহচর্যে নান্দনিক সৌন্দর্যমত্তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকেন অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। কণ্ঠশিল্পী ভেঙ্কটেশকুমার কৌশিকী কানাড়া রাগ রূপায়ণে সার্থক। উল্লেখ্য তাঁর আশের কাজ, ছন্দোময় বাণীবিন্যাস, গমকযুক্ত বোলতান, পরিচ্ছন্ন অতি দ্রুত তানকর্তব। পরে পেশ করেন তিনতালে একটি বন্দিশ ‘কাহে করত মোসে বরজোরি’। এই পর্বেও তাঁর উপরোক্ত গুণাবলির ঘাটতি ছিল না। বসন্ত বাহারে তিনতালের একটি বন্দিশ, পিলু ঠুমরি ও ভজন শুনিয়ে তিনি অনুষ্ঠান শেষ করেন। সঙ্গত সহযোগী সমর সাহা নিষ্ঠা ও সংযমের প্রতীক। হারমোনিয়ামে হিরণ্ময় মিত্র আদ্যন্ত বিশ্বস্ত।
প্রথম অধিবেশনের শেষ অনুষ্ঠানে অংশ নেন আশিস খান, আলম খান ও ধ্যানেশের পুত্র সিরাজ আলি খান। বাজান আহির ভৈরো। আলাপ, জোড়, ঝালা মোটামুটি। তিনটি সরোদের সহাবস্থান ঠিক না হওয়ায় পরিবেশনা মাঝে মাঝে ধাক্কা খাচ্ছিল। তবুও বলব কিছু ছন্দের কারুকাজ, তান-সহ তেহাই, সাথ সঙ্গত, সওয়াল জবাব আকর্ষক। পরে মিশ্র ভৈরবীতে দাদরা তালে রাগমালা ও শেষে ভৈরবীতে দ্রুত তিনতাল পরিবেশিত হয়। এই পর্বে সওয়াল জবাব উল্লেখযোগ্য। স্বপনের অনন্যসাধারণ সঙ্গত সহযোগ মূল অনুষ্ঠানটিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
দ্বিতীয় অধিবেশনের প্রথম শিল্পী মহি বাহাউদ্দিন ডাগর। তাঁর প্রথম নিবেদন রাগ দুর্গা। নিখুঁত সুরেলা উপস্থাপনা। উদারায় রাগরূপায়ণে পরতে পরতে দুর্গার স্তুতি উপচে পড়ছিল। স্বরসঙ্গতি রকমারি ছন্দ ও সুরবিন্যাসে ঋদ্ধ। তারার ‘সা’ থেকে ‘ধা’-এ আসার সময় শুদ্ধ ‘নি’কে কুশলতার সঙ্গে ব্যবহার করে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। জোড় পর্বে নানা ছন্দের অবতারণা করে গত ধরলেন চৌতালে। বিচিত্র ছন্দের তেহাই মনোজ্ঞ। পরে তিনি রাগ ধরেন পুরিয়া বসন্ত। নিমা(কড়ি)-এর অসাধারণ মিড়ের ব্যবহার নজর কাড়ে। পাখোয়াজে সঞ্জয় ওয়াগলে বিশ্বস্ত সহযোগী।
প্রবীণ শিল্পী অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় রাগ মালকোষ বিন্যস্ত করেন। সতেজ কণ্ঠ, মিড়ের কাজ, বাণীবিন্যাস এবং উদারার অংশে তিনি সজীব ছিলেন। বাহারি সরগম, দ্রুত লয়ে বিচিত্র ওজনদার তান, গমক বিস্ময়ের উদ্রেক করে। দ্রুত খেয়াল পরিবেশন করেন তিনতালে। মনোহারী বন্দিশ। গতিময় দ্রুত তানের কিছু উজ্জ্বল নমুনা এই পর্বে মেলে। তাঁর দ্বিতীয় নিবেদন রাগ সরস্বতীর দু’টি বন্দিশ। স্বল্প সময়ের মনোজ্ঞ পরিবেশনা। তবলায় আনন্দগোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়, হারমোনিয়ামে তাঁর সুযোগ্য ছাত্র শুভ্রকান্তি চট্টোপাধ্যায় সুন্দর মেজাজে তাঁকে সহযোগিতা করেন। |
|
|
শাহিদ পারভেজ |
আমান আলি খান |
|
রাগ মারুবেহাগ নিয়ে আসরে উপস্থিত মণিলাল নাগ। আলাপ জোড় ঝালা। সুচারু পরিবেশনা। বিলম্বিত তিনতাল পর্বে বিচিত্র তেহাই, লয় বিন্যাস, ত্রৈমাত্রিক ছন্দের কারুকাজ তৎ-সহ মনোজ্ঞ তেহাই উপস্থাপনাকে সমৃদ্ধ করে। এর পর মধ্য লয় তিনতালে চারগুণের ছোট ছোট তান, ছন্দোময় ঝালার পরে ঝাঁপতালে একটি গত ধরেন যোগ রাগে। বিস্তার পর্ব সুখশ্রাব্য। সুরে ছন্দে বর্ণময়। পরবর্তী দরবারি আলাপের অংশটি জমজমাট। আন্দোলিত গান্ধার মধ্যম ছুঁয়ে ষড়জে স্থিত হওয়া সুখকর। এর পর মধ্য লয় তিনতাল গতে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি। শুভেন চট্টোপাধ্যায় শিল্পীর চাহিদা অনুযায়ী সাহচর্য দেন।
চন্দ্রকোষকে নিয়ে পথ চলা শুরু অজয় চক্রবর্তীর। ‘এ কবহী’ বিলম্বিত একতালে নিবদ্ধ। চন্দ্রকোষের নানা স্বরসঙ্গতির সংযোজনে নতুন নতুন নিরীক্ষা।
কিছু কিছু চমকপ্রদ সরগম। বোলতান ও বাণীবিন্যাসের বাহার নিমেষে মন কাড়ে। পরে ঝাঁপতালে ‘আজ আও লগন’। বাহারি সরগম নিয়ে লয়কারি অসাধারণ। এই পর্বে কিছু সওয়াল জবাব পেশ করেন তিনি। সমর সাহার সঙ্গে মধুর সমঝোতায় এই উপহার উপভোগ্য হয়। পরবর্তী তিনতালে তান সরগম বিচিত্র ছন্দের খামতি ছিল না। দুই সহযোগী শিষ্য সুতালিমের পরিচয় রেখেছেন। খেয়ালের পর অজয় শোনালেন দীপচন্দিতে নিবদ্ধ মিশ্র পিলু ‘কাটে না বিরহ কী রাত’। বর্ণময় বোল বানানায় ঠুমরিটি সমৃদ্ধ। গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের রচনা ‘যদি কণ্ঠ দাও’ গানটি অজয় স্বামী বিবেকানন্দের উদ্দেশে নিবেদন করেন। সমরের তবলার মতো রূপশ্রীর হারমোনিয়ামও আনন্দ দেয়।
দিনের প্রথম আলোককে স্বাগত জানিয়ে বসন্ত মুখারিকে চয়ন করে মঞ্চে এলেন সেতার শিল্পী শাহিদ পারভেজ। সুস্থিত আলাপের পর জোড় পর্বে সুরেলা ওজনদার স্ট্রোক শব্দের প্রক্ষেপণ নিয়ে তার পরিক্রমণ বাহবার যোগ্য। জোড়ের পর্বে রাগের ট্রিটমেন্ট কাব্যিক সুষমামণ্ডিত। পরিমিত টোকায় স্বরাবলির পেলব সমন্বয়ে গমক উল্লেখ্য। বসন্ত মুখাবি শাহিদের বাদনশৈলীর নৈপুণ্য যেন বসন্ত মুখরিত এক ভোরের আগমন বার্তা বয়ে আনে। ঝালা তো নয়, যেন সুর ছন্দের প্রবাহে হারিয়ে যাওয়ার পালা। মুখড়াকে সঙ্গী করে কত না ছন্দের বিভাজন এবং পরে তেহাই সমেত সমে ফেরা। ত্রৈমাত্রিক ছন্দ, গমকের বাহার অপার আনন্দ জুগিয়েছে। মধ্য লয় তিনতালে আট গুণের ছোট ছোট তান করে মুখড়ায় ফেরা অসামান্য দক্ষতার স্বাক্ষর বহন করে। দ্রুত তিনতালের একটি গতে অসাধারণ ঝালার নমুনা পেশ করেন। শেষে ভৈরবীতে ‘বাবুল মোরা’ নিমেষে সুরের এক পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়। সব শেষে শোনান একটি বর্ণময় দাদরা। শুভজ্যোতি গুহর সরস তবলা সহযোগিতা শাহিদ ও শ্রোতা উভয় মহলকেই খুশি করে। তৃতীয় অধিবেশনের নান্দীপাঠ হয় কৌশিকী দেশিকানের কণ্ঠসঙ্গীতে। বিশ্লেষণ করেন বাগেশ্রী। বিলম্বিত একতালে ‘কৌন গত ভইরি’। তাঁর সুরঋদ্ধ কণ্ঠ, কণ্ঠের ব্যাপ্তি উল্লেখযোগ্য। তাঁর সাধনা, লয়ের উপর দক্ষতা সব কিছুই শ্রোতাদের কাছে অভিনন্দিত হয়েছে। পরের বন্দিশটি ঝাঁপতালে। বিভিন্ন ছকে সরগম, অতি দ্রুত তানকর্তব, অতি তারসপ্তকে ষড়জ ছুঁয়ে মুখড়ায় ফেরা প্রশংসনীয়। পরবর্তী দু’টি বন্দিশ তিনতাল ও দ্রুত একতালে। এই অংশেও সরগম, লয়কারি, অতি দ্রুত তান সমাদর লাভ করে। এর পর শ্রোতার অনুনয়ে তিল্লানা গাইতে হয়। তাঁর শেষ নিবেদন বড়ে গোলাম আলির বহুশ্রুত ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’। তবলায় শুভাশিস ভট্টাচার্য, হারমোনিয়ামে রূপশ্রী যোগ্য সহযোগীর ভূমিকা নেন। |
|
|
অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় |
এম ভেঙ্কটেশ |
|
বিলম্বিত একতালে রাগ কেদারা নিয়ে মঞ্চে আসীন হলেন রাজেন্দ্র প্রসন্ন। তাঁর গায়কি অঙ্গের বাদনে রাগরূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অভ্রান্ত সুরচারণা। তানকারি সুখপ্রদ। দ্রুত তিনতালের বন্দিশটি সুন্দর। এই পরিসরে বিবাদী স্বর হিসেবে কোমল নি-র ব্যবহার লক্ষণীয়। অতি দ্রুত তানকারি মন কাড়ে। পরের নিবেদন চন্দ্রকোষ। এই পর্বে ছোট ছোট অতি দ্রুত তান করে মুখড়ায় ফেরা আনন্দদায়ক। পরে তিনি পাহাড়ি ধুন ধরেন। ছোট বাঁশিটি হাতে তুলে নেন এবং অচিরেই শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। পিলু রাগে আর একটি ধুন বাজিয়ে তাঁর বাদনশৈলীর ইতি টানেন। সহযোগিতায় তাঁর পুত্র ঋষভ প্রসন্ন এবং তবলায় তন্ময় বসু আদ্যন্ত আশ্বস্ত রেখেছিলেন মূল শিল্পীকে।
অশ্বিনী ভিড়ে দেশপাণ্ডে তবলায় বিনোদ লেলেকে নিয়ে বিন্যস্ত করেন জয়জয়ন্তী। প্রথমে ঝাঁপতাল পরে আড়া চৌতালে। পরিচ্ছন্ন রাগদারি প্রত্যয়ী সুরচারণা। ওজনদার কণ্ঠ তাঁর গানকে ঘিরে রেখেছিল। তানকারি যথাযথ। ‘সুন্দর শ্যাম সলোনে’ আড়া চৌতালের বন্দিশটি বেশ মনোগ্রাহী। রূপায়ণও সুন্দর। পরে পঞ্চম সওয়ারিতে শঙ্করায় একটি রচনা গেয়ে তিনতালে দ্বিতীয় রচনা ও ‘পিয়া যাও যাও’ পেশ করেন। তাঁর সযত্ন গায়কিতে বন্দিশটি নতুন মাত্রা পায়। খেয়াল শেষে পিলু ঠুমরি ও কবীরের একটি ভজন। তবলায় বিনোদ লেলে, হারমোনিয়ামে দেবপ্রসাদ দে যোগ্য সহযোগী।
নজরুল মঞ্চে মধ্য রাতে আমান আলি খানের সরোদে নেমে এল মালকোষ। ধামার তালে। সঙ্গে দুই সহযোগী সত্যজিৎ তলোয়ালকর ও ফতে সিংহ গাংগানি। রাগ রূপায়ণে মুন্সিয়ানা যেমন, নি ধা মা গা সা ধা, সা...মা গা সা নি ধা নি , সা গা গা ধা এই স্বরচারণা রাগের রূপ উন্মোচনে সহায়ক হয়। জোড় পর্বে নানা ছকে দৃপ্ত তানের মূর্ছনায় চার পাশের পরিবেশ মুহূর্তে তাঁর আয়ত্তে এসে যায়। ছন্দের কারুকৃতি, গমকের কারুকাজ, একহারা তানের দাপট এবং সাপট তান করে সমে ফেরা এক অনাস্বাদিত আনন্দের খোরাক জোগায়। এর পর তিনি গত ধরেন ধামার তালে। কী অসাধারণ লয় বিভাজন, কী অসাধারণ তেহাই। চকিতে ধা সা নি সা ধা নি ধা এই স্বরাবলিকে সঙ্গী করে ধ্বনি প্রতিধ্বনির খেলা আনন্দ দেয়। এই পর্বে চৌগুণের তান, ত্রৈমাত্রিক ছন্দ অসম্ভব তৈয়ারির উদাহরণ রাখে। পরে তিনতাল গত। ছোট ছোট তান, লয়কারি করে সমে ফেরা গমকের বাহার গতটিকে ঘিরে রাখে। এই ধরনের আর একটি বন্দিশ বাজানোর পর তাঁর পরের নিবেদন মিয়া কি টোড়ি। মধ্যলয় ঝাঁপতালে। মুহূর্তে রাত্রির আমেজ কেটে গিয়ে ভোরের আবেশ ফিরে আসে। এই পর্বেও সেই ছোট ছোট তান তেহাই অতি দ্রুত তানকারি। এর পর আরও দু’টি বন্দিশ পরিবেশিত হল দ্রুত একতাল ও দ্রুত তিনতালে। ঝালা দিয়ে সমাপ্তি। সহযোগী তবলা বাদকদের কুর্নিশ জানাতেই হবে। মূল শিল্পীর সঙ্গে এঁদের সমঝোতা কোনও সমালোচনার অপেক্ষা রাখে না। |
|
|
|
অজয় চক্রবর্তী |
যশরাজ |
রাশিদ খান |
|
তৃতীয় দিনের অধিবেশনের ইতি টানেন রাশিদ খান। শিল্পী নতুন ভোরের আগমন বার্তা জানিয়ে রাগ ললিত পরিবেশন করেন। বিলম্বিত একতালে তাঁর মাধুর্যময় কণ্ঠের বিস্তারে নিমেষেই রাগের রূপরেখা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। দুই মধ্যমের সুরের মিড়ে সবাইকে আপ্লুত করেন। ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন ধরনের সরগমের নকশা এঁকে বন্দিশে পৌঁছে যাওয়ায় আবেগের পাত্র পূর্ণ হয়ে ওঠে। দ্রুত, অতি দ্রুত তান,সঙ্গে তাঁর কণ্ঠের ওজস্বিতা স্মরণীয় ভাবে উল্লেখ্য। তাঁর পরিবেশনা বিশেষ ভাবে সমৃদ্ধ হয় ত্রয়ী সঙ্গতিয়া শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোতি গোহ ও মুরাদ আলির অকুণ্ঠ সহযোগিতায়। রাশিদের দ্বিতীয় চয়ন সোহিনী বাহার ঢিমা ঝাঁপতালে নিবদ্ধ। নানা লয়ের কারুকৃতিতে সরগমের ডালি ভরিয়ে মুখড়ায় ফেরা খুবই মনোগ্রাহী। দু’টি রাগই তাঁর নিবেদনের গুণে সুন্দর আতিথ্য পেয়েছে। রাশিদ অনুষ্ঠান শেষ করেন কিরবাণী আশ্রিত ঠুমরি গেয়ে।
শেষ রাতের প্রথম শিল্পী রুচিরা পান্ডার প্রথম পরিবেশনা রাগেশ্রী। শিল্পী বিলম্বিত একতাল পরে দ্রুত একতালে তাঁর গুরু মানস চক্রবর্তীর রচিত দু’টি বন্দিশ পেশ করেন। ওজস্বী কণ্ঠ, সঠিক স্বরচারণা, বিস্তার পর্বে মিড়ের অবতারণা এবং সরগমের ব্যবহার করে সুস্থিত চিন্তাধারার পরিচয় রাখেন। তানকারি স্বচ্ছন্দ। খেয়ালের পর তিনি মিশ্র পাহাড়ি রাগে বিরহ পর্যায়ের ঠুমরি শোনান। এটির রচয়িতাও তাঁর গুরু। ঠুমরির ভাবটি যত্নসহকারে ফুটিয়ে তোলেন। তবলায় অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, হারমোনিয়ামে রঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের সযত্ন সহযোগিতা শিল্পীকে অনুপ্রাণিত করেছে।
রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করে আসর শুরু করলেন আমজাদ আলি খান। তিনি শ্রদ্ধার মালাটি গাঁথলেন নানা রাগে কখনও শ্রী, কখনও মারবা, কখনও পূরবী, ভাটিয়ার ও ললিতা গৌরীতে। পরে দীপচন্দিতে একটি মনোজ্ঞ রচনা পেশ করেন, যার ছত্রে ছত্রে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির আদলটি নিখুঁত ভাবে ফুটে ওঠে। তাঁর পরের নিবেদন শুদ্ধকল্যাণ নিবেদিত হল প্রয়াত ভীমসেন যোশীর স্মৃতিতে। সুবিন্যস্ত আলাপ জোড়। অল্প পরিসরে রাগটি প্রাণপ্রতিষ্ঠা পেল। জোড় অঙ্গে লপেট ও জমজমার কাজ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এর পর তাঁর দুই পুত্র আমান ও আয়ান রচিত বাগেশ্রী রাগে সাড়ে বারো মাত্রার তালে নিবদ্ধ একটি বন্দিশ শোনান। নিঃসন্দেহে তিনি তাঁর ভাব, ভাবনা, নান্দনিকতাবোধ, সাধনা দিয়ে এক অনন্যসাধারণ উপহার দিয়েছেন। পরে দ্রুত তিনতাল গত। একহারা তানের অপূর্ব উদাহরণ মিলল। তবলিয়া শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁর চলার পথে সার্থক পথিক হতে পেরেছেন। এর পর তাঁর নিবেদন দুর্গা। তিনতাল। বিস্তার পর্ব সুরে সুরে সুরময়। সারে সারেপা এই স্বরাবলিকে সঙ্গী করে কিছু অসামান্য তানকারি, তেহাই মনে রাখার মতো। পরবর্তী পরিবেশনা সরস্বতী কল্যাণ। এই রচনায় শুদ্ধ গান্ধারের আবেদন মনকে নাড়া দেয়। মূলত বিস্তার অঙ্গের পরিবেশনায় তিনি নানা প্রকার দুরূহ ছন্দ, একহারা তান ও নানা অঙ্গের তেহাই পেশ করেন। এর পর আসে তাঁর স্বসৃষ্ট রাগ স্বর সমীর। স্বল্প পরিবেশনার পর তিনি চলে যান খাম্বাজে। গায়কি অঙ্গের বাজনায় অসাধারণ প্রকাশ ঘটে বিস্তার পর্বে। পরে তিনি গত ধরেন বিলম্বিত তিনতালে। দুই নিখাদকে নিয়ে কী অপূর্ব খেলা। মনে হচ্ছিল মন আর মনন মিলেমিশে একাকার। এর পর দাদরা তালে লোকসুরে গাঁথা ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’। এর মাঝে কখনও চারুকেশী, শিবকল্যাণ আবার অসমীয়া লোকগীতিতে অনায়াস বিচরণ শ্রোতাদের সুরের আঙিনায় সহজেই পৌঁছে দেয়। শুভঙ্কর প্রার্থিত সহযোগিতার ঊর্ধ্বে বললেও অত্যুক্তি হয় না। |
|
|
এন রাজম |
কৌশিকী চক্রবর্তী দেশিকান |
|
শেষ রাতের তৃতীয় শিল্পী মঞ্জিরি আসনারে কেলকর চয়ন করেন সম্পূর্ণ মালকোষ। সতেজ কণ্ঠ, অনায়াস বিচরণ, মেজাজটিও ভাল। তানকারিতে স্বচ্ছ সাবলীল। লয়ের উপর ভাল দখল আছে। আকার তান বেশ দানাযুক্ত। এর পর সোহিনীতে একটি বন্দিশ পেশ করেন। ছন্দের সুন্দর কাজে নান্দনিকতার পরিচয় মেলে। সোহিনীর পর দাদরা তালে একটি ভাবরসোত্তীর্ণ রচনা শোনান। সিন্ধুরা রাগে আর একটি রচনা শোনাবার পর দীপচন্দি তালে একটি ভজন গেয়ে অনুষ্ঠান শেষ করেন। শেষ হবার পরও রেশ রেখে যায়। সঙ্গতে বিনোদ লেলে, হারমোনিয়ামে গৌরব চট্টোপাধ্যায় দু’জনেই সুখকর সহযোগিতা করেন।
বেহালায় বাগেশ্রী কানাড়ার উপচার নিয়ে এলেন এন রাজম। অসাধারণ তাঁর সুরের অভিব্যক্তি। গা মা রে সা নি পা গা মা ধা কী অপূর্ব তাঁর মিড়ের প্রয়োগ। ভরপুর সুর আর মিড়ের ধারায় স্নাত হয়েছে আপামর শ্রোতা। এর পর মধ্যলয় তিনতালে একটি গত ধরেন। এই পর্বে লয়, ছন্দের কাজ, তানের নানা ছক চিত্তাকর্ষক। দ্রুত তিনতাল গতে অতি দ্রুত তানকর্তব এবং অতি তারসপ্তকের ষড়জে স্থিত হয়ে শব্দকে নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি অনবদ্য। দ্বিতীয় নিবেদন দেশ। ওঁর বাদনশৈলী ওঁঙ্কারনাথ ঠাকুরের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল। সেই আকুতি, সেই আবেগ। এর পর তিনি পরপর দু’টি ভজন পরিবেশন করেন। বৈষ্ণব জনতো ও পাওজী ম্যায়নে। স্মরণীয় পরিবেশনা। সহযোগিতায় তাঁর তালিমপ্রাপ্ত শিষ্যা প্রতিশ্রুতির পরিচয় রেখেছেন। তবলা সহযোগিতায় অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক ফোঁটাও খামতি ছিল না।
সম্মেলনের সমাপ্তি শিল্পী যশরাজ। বৈরাগী ভৈরবের বন্দিশ ধরলেন বিলম্বিত একতালে। রাগ বিস্তার করেন উদারা মুদারায় বিচরণ করে। সরগম ও গমকের কাজ এ ক্ষেত্রে বাদ যায়নি। প্রথমে ছোট ছোট তান ও পরে বড় তান করে মুখড়ায় এসে একটি সুন্দর আবহ তৈরি করেন।
এর পর দ্রুত তিনতাল। এই পর্বে তিনি সরগম-গমকের ব্যবহার ও তানকর্তবে সাবলীল ছিলেন। এর পর যশরাজজির ভজনে প্রবেশ। প্রথমে কাহারবায় প্রভু প্রাণনাথ, শেষ ভজনটি নিরঞ্জনী নারায়ণী ও কাহারবায় বাঁধা ছিল। মাঝে একটি ভৈরবী দাদরা শোনান।
চার জন ছাত্র ওঁকে সহযোগিতার ক্ষেত্রে সব সময় স্বস্তিতে রাখার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। তবলিয়া রামকুমার মিশ্র ও হারমোনিয়াম শিল্পী মুকুন্দ পেটকরের ক্ষেত্রেও একই বিশেষণ প্রযোজ্য।
|
ছবিগুলি তুলেছেন অশোক মজুমদার, সুমন বল্লভ, বিশ্বনাথ বণিক |
|
|
|
|
|