বড়ঞা ব্লক তথা মুর্শিদাবাদ জেলার পটশিল্প ও পটুয়া সমাজ আজ বিপন্ন। পটুয়ারা কেবল চিত্রকরই নয়, তাঁরা সুর করে গান গেয়ে পট প্রদর্শনেও নিপুণ গায়ক। বড়ঞা ব্লকের মূলত তিনটি জনপদ কাতুরহাট, পাঁচথুপি ও গোলাহাটে পটুয়া সম্প্রদায়ের বাস। ওই জনপদগুলির পটের চিত্রশৈলীর সঙ্গে বীরভূম জেলার পট শিল্পের সাযুজ্য রয়েছে। বড়ঞা ব্লকটি এক সময় বীরভূম জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। পট আঁকার রঙের উপাদান পটুয়ারা সংগ্রহ করতেন প্রকৃতি থেকে। সীমের পাতা, পলাশ ফুল ও তেঁতুল বীজ থেকে তাঁরা রং তৈরি করতেন। লোকসংস্কৃতির রূপভেদে পটশিল্পের বিষয়ও বিভিন্ন পুরাণ কেন্দ্রিক। পটে স্থান পেয়েছে হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন বিষয় সাবিত্রী সত্যবান, কৃষ্ণলীলা, নিমাইয়ের সন্ন্যাস, অহল্যা ও রামলীলা জাতীয় কাহিনি। ওই পটুয়ারা কিন্তু অসাম্প্রদায়িক। কারণ তাঁদের বিশেষ কোনও সম্প্রদায়গত ধর্ম নেই। ইসলাম ও হিন্দু--উভয় ধর্মের ভাবধারা মিশে থাকে তাঁদের প্রাত্যহিক জীবন চর্চায়। এঁদের বিবাহ রীতিও অনাড়ম্বর। ইদানিং সামান্য বরপণ চালু হলেও আগে ছিল না। বিবাহে যেমন গায়ে হলুদের মতো অনুষ্ঠান হয়, তেমনই আবার পাত্রপাত্রী উভয়কে ইসলাম ধর্মীয় রীতি অনুাসারে ‘কলমা’ও পড়তে হয়। বিবাহের দিন ইসলামীয় প্রথা মতো পাত্রের পক্ষ থেকে পাত্রীর কাছে ‘ইজাব’ (বিয়ের প্রস্তাব) দেওয়া হয়। তার পর পাত্রীর কাছ থেকে বিয়ে করার ‘ইজিন’ (সম্মতি) নেওয়া হয়। তার পর বিয়ে। বিবাহিত রমণীর সিঁথিতে সিঁদুর নেওয়া ঐচ্ছিক। পটুয়াদের মধ্যে নামাজ, রোজা ও অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ায় কবরের প্রচলন থাকলেও হিন্দু পৌরাণিক ধর্মীয় আখ্যান অবলম্বন করেই তাঁরা গান, কথকতা ও পটচিত্র সৃষ্টি করেন। তার পর একটি ত্রিভুজাকৃতি স্ট্যান্ডের উপর পটচিত্রটি রেখে সুর করে গাওয়ার মধ্যেই তাঁদের উপার্জন। পটের দর্শক ও শ্রোতার বিষয়ে কিশোর ও বালকদের আগ্রহের কথা বিশাখদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’ নাটকে দেখা যায়। স্বশিক্ষিত ওই সব পটশিল্পী ও তাঁদের সৃষ্ট পটশিল্প আজ অবলুপ্তির পথে। প্রাচীনতম শিল্প মাধ্যমগুলির মধ্যে অনন্য ওই পটশিল্প ও তাদের স্রষ্টা পটশিল্পীদের পুনরুজ্জীবনের জন্য সরকার, অথবা অসরকারি কোনও প্রতিষ্ঠান কিছু করতে পারে কী?
সুভাষ ঘোষ হাজরা, পাঁচথুপি |