|
|
|
|
লড়াই চলবে, বলছে তৃণমূল |
সুপ্রিম কোর্টে শর্তাধীন জামিন পেলেন সুশান্ত |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
প্রায় পাঁচ মাস জেলে থাকার পর ‘শর্তাধীনে’ জামিন পেলেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী, সিপিএম নেতা তথা গড়বেতার বিধায়ক সুশান্ত ঘোষ। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আলতামাস কবীর ও বিচারপতি জ্ঞানসুধা মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চ শুক্রবার প্রাক্তন মন্ত্রী সুশান্তবাবুকে শর্তসাপেক্ষে জামিন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
জামিন পেলেও আপাতত আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বন্দি সুশান্তবাবুকে মুক্তি পেতে আরও কিছু ধাপ পেরোতে হবে। নিয়ম অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ‘সার্টিফায়েড’ অনুলিপি সংগ্রহ করে তাঁর আইনজীবীরা জমা দেবেন ট্রায়াল কোর্টে। যেখানে মূল মামলাটির শুনানি চলছিল। সেই নিম্ন আদালত আরও কিছু শর্ত আরোপ করতে পারে। আবার একই শর্ত রাখতে পারে। নিম্ন আদালত থেকে জামিনের কাগজ নিয়ে তবেই সুশান্তবাবু জেল থেকে বেরোতে পারবেন। সেই প্রক্রিয়া আজ, শনিবার সম্পন্ন হয় কিনা, নাকি আরও কয়েকদিন লাগে, তা-ই এখন দেখার।
সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকারের আইনজীবী তথা তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন বলেছেন, “আদালতের দেওয়া শর্তগুলির মধ্যে রয়েছে, সুশান্তবাবু তাঁর নির্বাচনী এলাকা ছাড়া মেদিনীপুর জেলার অন্যত্র যেতে পারবেন না।” সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা আরও জানিয়েছেন, জামিনের শর্তে বলা রয়েছে, যে এলাকায় তিনি থাকবেন, সেই থানায় প্রতি মাসের শেষ রবিবার তাঁকে গিয়ে হাজিরা দিতে হবে। তা ছাড়া, যেখানে তিনি থাকবেন, সেখান থেকে অন্যত্র কোথাও (গড়বেতা বাদে) যেতে গেলেও পুলিশকে তা জানিয়ে যেতে হবে।
সুশান্তবাবুর জামিন নিয়ে যথারীতি শাসক ও বিরোধী শিবিরের মধ্যে চাপানউতোর শুরু হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি জানিয়েছেন, আইন আইনের পথে চলবে। মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রের আরও বক্তব্য, সুশান্তবাবু শুধু একটি মামলাতেই অভিযুক্ত নন। অভিযোগ অনেক। মামলার জল কোন দিকে গড়ায়, তা এখনও দেখা বাকি। প্রত্যাশিত ভাবেই, সুশান্তবাবুর জামিনের অবসরে বিরোধী সিপিএম ফের রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ‘প্রতিহিংসা পরায়ণতা’র অভিযোগ এনেছে। কঙ্কাল-কাণ্ডে প্রাথমিক এফআইআরে কেন তৎকালীন মন্ত্রী সুশান্তবাবুর নাম ছিল না, তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিরোধী শিবির থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। যার জবাবে এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে বলা হয়েছে, তখন পশ্চিম মেদিনীপুরের যা পরিস্থিতি ছিল, তাতে ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ নেতা সুশান্তবাবুর নামে থানায় অভিযোগ দায়ের করা সম্ভব ছিল না।
|
তিন শর্ত |
• নিজের বিধানসভা কেন্দ্র (গড়বেতা) ছাড়া পশ্চিম মেদিনীপুরে গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ |
• জেলার অন্যত্র যেতে মেদিনীপুর আদালতের অনুমতি লাগবে |
• যেখানে থাকবেন, সংশ্লিষ্ট থানায় মাসের শেষ রবিবার হাজিরা |
|
জেলা আদালত ও কলকাতা হাইকোর্টে জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন সুশান্তবাবু। গত সোমবার তাঁর জামিনের আবেদন নিয়ে আড়াই ঘণ্টা শুনানি চলে। এ ব্যাপারে রায় ঘোষণার কথা ছিল বুধবার। পরে আদালত জানায়, শুক্রবার ওই মামলার রায় জানানো হবে। সেইমতোই এ দিন সুশান্তবাবুর শর্তাধীন জামিনের নির্দেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।
সুশান্তবাবুর জামিনের আবেদন মঞ্জুর হওয়ায় তাঁর দল সিপিএম স্বভাবতই ‘খুশি’। দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘যে রাজ্য সরকার প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে নানা রকম অভিযোগ সাজিয়ে কমরেড সুশান্ত ঘোষকে হেনস্থা করতে উঠে-পড়ে লেগেছে, তাদের এই অন্তর্বর্তী জামিনের ঘটনা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা উচিত’। বিরোধী দলনেতা তথা সুশান্তবাবুর জেলা পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে নির্বাচিত বিধায়ক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “আমরা আনন্দিত। ন্যায়বিচারের পথে আংশিক জয় হয়েছে। বিশ্বাস করি, শেষ লড়াইয়েও আমরা জিতব। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা, প্রমাণিত হবে।” বিরোধী দলনেতার আরও বক্তব্য, “রাজ্য সরকার দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটিয়েছে। বিধায়ক হওয়া সত্ত্বেও মামলায় জড়িয়ে সুশান্তবাবুকে বিধানসভার বাজেট অধিবেশনে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। শুধু সুশান্তবাবুই নন, আমাদের ছ’হাজারেরও বেশি নেতা-কর্মীকে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।”
পক্ষান্তরে, প্রধান শাসক দল তৃণমূলের আশা, জামিনে সাময়িক মুক্তি পেলেও সুশান্তবাবুর সাজা হবেই। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়ের কথায়, “জামিন পাওয়া মানে অভিযোগ থেকে মুক্ত হওয়া নয়। যত কঙ্কাল উদ্ধার হয়েছে, প্রত্যক্ষদর্শীরা যা সাক্ষ্য দিয়েছেন, আমার বিশ্বাস আইনের আদালতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হবেন।” একই ভাবে রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম মহাকরণে বলেছেন, “আইন আইনের পথে চলবে। এটা সাময়িক ‘রিলিফ’। মানুষের আদালতে শাস্তি পাবেই। এতগুলো কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে। যোগ্য সাজা হবেই।” জামিনের পরে ওই এলাকায় কোনও অশান্তির আশঙ্কা করছেন কি? মন্ত্রীর বক্তব্য, “কোনও অশান্তির আশঙ্কা দেখছি না। মানুষ আগে ভয়ে থাকতেন। এখন তাঁরা প্রতিবাদ করছেন। এগিয়ে আসছেন।” |
অথ সুশান্ত কথা |
২০০২ |
২০১২ |
২২ সেপ্টেম্বর: কেশপুরের পিয়াশালায়
সিপিএমের
হামলা। দুই তৃণমূল সমর্থকের
দেহ উদ্ধার, নিখোঁজ ৫ |
২৭ জানুয়ারি: জেলা জজের নির্দেশ, বিচার
হবে মেদিনীপুরের
চতুর্থ দায়রা কোর্টে।
১৬ ফেব্রুয়ারি
শুনানি ধার্য |
২৩ সেপ্টেম্বর: ২০ সিপিএম নেতা-কর্মীর
নামে
মামলা। প্রমাণাভাবে সকলে খালাস |
৩ ফেব্রুয়ারি: শর্তাধীনে সুশান্তের
জামিন সুপ্রিম কোর্টে |
২০১১ |
৪/৫ জুন: দাসেরবাঁধে
হাড়গোড় উদ্ধার।
দাবি,
পিয়াশালার নিখোঁজদের দেহাবশেষ |
৬ জুন: নতুন অভিযোগ
সুশান্ত-সহ
৪০
সিপিএম
নেতা-কর্মীর নামে |
৭ জুন: সিআইডি তদন্ত শুরু |
১৮ জুলাই: হাইকোর্টে সুশান্তের আগাম জামিন |
৯ অগস্ট: ডিএনএ-
রিপোর্টের
ভিত্তিতে জামিন
খারিজের আর্জি |
১১ অগস্ট: জামিন খারিজ মেদিনীপুর
কোর্টে, সিআইডি হেফাজতে সুশান্ত |
২৩ সেপ্টেম্বর: সুশান্ত-সহ
৫৮ সিপিএম
নেতা-কর্মীর
বিরুদ্ধে চার্জশিট |
২৩ সেপ্টেম্বর: তরুণ রায়, এন্তাজ আলি,
তড়িৎ খাটুয়া,
সুশান্তের ভাই প্রশান্ত-সহ
৩৮ জন ‘ফেরার’ ঘোষিত |
|
|
বিরোধী দলনেতার মন্তব্যের প্রেক্ষিতে ফিরহাদ বলেছেন, “সিআইডি তদন্ত চলছে। তাই আনন্দিত হওয়ার
কোনও কারণ নেই!” সুশান্তবাবুর জামিন-লাভে তাঁদের ‘মনোবল’ বাড়ল কি? সূর্যবাবুর কথায়, “আমাদের মনোবল কম নেই! যত লোককে ধরা হয়েছে, তার দশ গুণ লোককে গ্রেফতার করলেও আমাদের কর্মীদের মনোবল কমবে না। রাজ্য সরকার যে প্রতিহিংসামূলক আচরণ করছে, সেটা স্পষ্ট হবে।” সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সূর্যবাবু ইঙ্গিত দিয়েছেন, রাজ্য সরকারের ‘প্রতিহিংসার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক’ হিসাবে সুশান্তবাবুকে নিয়ে বিভিন্ন জেলা নেতৃত্ব ‘স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে’ নানা কর্মসূচি নিতে পারে। অর্থাৎ জেলের বাইরে থাকলে (জেল থেকেই সদ্য পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কমিটিতে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন) দলে সুশান্তবাবুর ‘চাহিদা’ বাড়বে।
রাজ্যে পালাবদলের পরে জুন মাসে পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতার দাসেরবাঁধে মাটি খুঁড়ে উদ্ধার হয় কিছু হাড়গোড়। ওই দেহাবশেষ প্রায় দশ বছর আগে কেশপুরের পিয়াশালা থেকে নিখোঁজ কিছু তৃণমূল কর্মীর বলে দাবি ওঠে। এলাকাটি বেনাচাপড়ায় সুশান্তবাবুর পৈতৃক বাড়ির অদূরেই। তৃণমূল অভিযোগ করে, তাদের কর্মীদের ‘গুমখুন’ করে প্রমাণ লোপাটের জন্য দেহগুলি কবর দেওয়া হয়েছে। ‘নিখোঁজ’ অজয় আচার্যের ছেলে শ্যামল আচার্য কেশপুরের আনন্দপুর থানায় ৪০ জন সিপিএম নেতা-কর্মীর নামে খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। তদন্ত-ভার দেওয়া হয় সিআইডি-কে। ‘নিখোঁজ’ মামলায় নাম জড়ানোর পরে হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিন পেলেও সুশান্তবাবুর ‘অস্বস্তি’ ছিলই। দাসেরবাঁধে উদ্ধার-হওয়া হাড়গোড় পিয়াশালা থেকে নিখোঁজ অন্তত দু’জনের পরিজনের ‘ডিএনএ’ নমুনার সঙ্গে মিলেছে বলে আদালতে জানায় সিআইডি। কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দিও উল্লেখ করে তারা। মেদিনীপুরের সিজেএম আদালত ১১ অগস্ট প্রাক্তন মন্ত্রীর আগাম জামিন খারিজ করে দেয়। তখন থেকেই প্রথমে সিআইডি হেফাজত এবং তার পর জেলে সুশান্তবাবু। সুশান্তবাবু-সহ ৫৮ জন সিপিএম নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে সিআইডি। বাকি ৩৮ জনকে ‘পলাতক অপরাধী’ বলে ঘোষণা করে তাঁদের স্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। এঁদের মধ্যে আছেন সুশান্তবাবুর ভাই প্রশান্ত ঘোষ এবং সিপিএমের কৃষক সভার রাজ্য সম্পাদক তরুণ রায়। ১৬ ফেব্রুয়ারি মেদিনীপুরের চতুর্থ অতিরিক্ত জেলা দায়রা বিচারকের এজলাসে ওই মামলার শুনানির দিন ধার্য হয়েছে। সেই দিনই চার্জ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সম্ভাবনা।
|
|
|
|
|
|