উত্তর কলকাতা
কোথায় গড়ায়
সমস্যার জল
কালবেলাতেই দীর্ঘ লাইন। জারিকেন হাতে অসংখ্য মানুষ জলের জন্য দাঁড়িয়ে বিটি রোডের ধারে। সেই জল নেওয়া নিয়ে রীতিমতো বচসাও চলছে। সম্প্রতি টানা দু’দিন ধরে বিটি রোডের ধারে এই ছবি দেখলেন পথচলতি মানুষ। কারণ, বরাহনগরে জল সরবরাহের অন্যতম মূল পাইপটি ফেটে যাওয়ায় মেরামতির জন্য জল সরবরাহ বন্ধ ছিল। কয়েকটি জায়গায় স্থানীয় পুরসভা জলের গাড়ি পাঠালেও প্রয়োজনের তুলনায় তা পর্যাপ্ত ছিল না।
বাসিন্দাদের দাবি, এমন অভিজ্ঞতা নতুন নয়। তবে ভোগান্তির মাত্রা এ বার ছিল বেশি। জলের পাইপলাইনের মেরামতির জন্য সরবরাহ বন্ধের ঘটনা আগেও ঘটেছে। জল যোগানের ক্ষেত্রেও বিস্তর অভিযোগ। বাসিন্দাদের অভিযোগ, নতুন পুরবোর্ড এসেও তেমন কিছু করতে পারছে না। এখনও অনেক জায়গায় জলের সরবরাহ প্রয়োজনের তুলনায় কম। পরিস্রুত পানীয় জলের জন্য টালা-পলতার জলের উপরেই নির্ভর করতে হয়। অভিযোগ কার্যত স্বীকার করে বরাহনগর পুরকর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাঁরা নিজস্ব ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরি করতে চলেছেন। সে ক্ষেত্রে সমস্যা অনেকটাই কমবে। কিন্তু পুরসভার বিরোধী দল সিপিএমের অভিযোগ, নতুন পুরবোর্ড উদ্যোগী নয়।
সমস্যার এখানেই শেষ নয়, বরাহনগরের মাটির তলায় কোথায় কী ভাবে জল সরবরাহের পাইপলাইন রয়েছে, সে নকশা কোথায় কার কাছে আছে কিংবা আদৌ পুরসভার কাছে আছে কি না সে সম্পর্কেও কোনও সদুত্তর মেলেনি। বাসিন্দাদের অভিযোগ, কলকাতা সংলগ্ন এই প্রাচীন জনপদ পরিকল্পনা ছাড়াই গড়ে উঠেছে। গত দশকে কলকাতার চাপ অনেকটাই এসে পড়েছে এই জনপদে। বেড়েছে বসতি, পাল্লা দিয়ে জনসংখ্যাও। কিন্তু জল সরবরাহ ব্যবস্থা সে তুলনায় পিছিয়েই রয়েছে। ফলে এ ধরনের সমস্যা হয়ে চলেছে।
বাসিন্দাদের দাবি, অস্থায়ী মেরামতি নয়, স্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা করুক প্রশাসন। বাসিন্দাদের কথার প্রতিধ্বনি মিলল বরাহনগর পুরসভার বিরোধী দল সিপিএমের কথাতেও। বিরোধী দলনেতা অশোক রায় বলেন, “পুরসভার সীমিত আর্থিক ক্ষমতার মধ্যে ওই মূল পাইপ সংস্কার করা সম্ভব নয়। ১৯৭৩-এ বসানো পাইপলাইন তুলে নতুন করে লাইন পাতার খরচ বিপুল। তা-ও পুর এলাকার সর্বত্র পৌঁছয়নি। আমাদের সময়ে এ বিষয়ে চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু বিশেষ সাফল্য আসেনি। তবে নকশা পুরসভার থাকার কথা।” তবে তাঁর দাবি, “আমাদের সময়ে একটি নিজস্ব ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরির কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু নতুন বোর্ডের সময়ে তা বন্ধ হয়ে যায়। সেটি হলে সমস্যার অনেকটাই সমাধান হত।”
বরাহনগর পুরসভার কাউন্সিলর তৃণমূলের অঞ্জন পাল বলেন, “প্রাচীন এই জনপদে বসতি যেমন বাড়ছে, জনসংখ্যাও বাড়ছে। অথচ জল সরবরাহ নিয়ে স্থায়ী পরিকল্পনা হল না। আমরা সবে ক্ষমতায় এসেছি। উপরন্তু আর্থিক সীমাবদ্ধতা আছে। তবে নিশ্চিত ভাবেই পরিকল্পনা করা হবে।” পুরকর্মীদের একাংশের মতে, নকশা নেই। কেএমডিএ-র কাছ থেকে নকশা চেয়েও পাওয়া যায়নি।
অভিযোগের জবাবে বরাহনগর পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান তথা জল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত রামকৃষ্ণ পাল বলেন, “তিনটি ভাগে বরাহনগর পুর এলাকায় জল সরবরাহ হয়। বরাহনগর-কামারহাটি যৌথ জলপ্রকল্প, পিএইচই এবং থার্ড ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে এই জল সরবরাহ করা হয়। থার্ড ওয়াটার ট্রিটমেন্ট থেকে বরাহনগর-সহ পাঁচটি পুর এলাকায় জল সরবরাহ করা হয়। কিন্তু সব মিলিয়ে বরাহনগরে জল সমস্যা আজও রয়েছে।”
কিন্তু কেন? জবাবে তিনি বলেন, “দীর্ঘ দিনের এই পাইপলাইনের সংস্কার-সহ জল সরবরাহ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের কাজের জন্য অর্থের প্রয়োজন। পুরসভার একার পক্ষে তা করা মুশকিল। এই নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হবে। ইতিমধ্যে আমরা একটি জলপ্রকল্প তৈরি করছি। বাম আমলে শুরু হলেও বিভিন্ন গাফিলতিতে তা বন্ধ হয়ে যায়। আগের বোর্ডের সময়ে বন্ধ হয়েছে। বর্তমান বোর্ডের ঘাড়ে দায় চাপালেই হবে না। প্রকল্প কার্যকর হলে সমস্যার অনেকটা সমাধান হবে।”
কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ দূর অস্ত্, পাইপলাইন কোথায় কী ভাবে রয়েছে, সে সম্পর্কে কেন এত ধোঁয়াশা? জবাবে রামকৃষ্ণবাবুর জবাব, “বিভাগীয় গাফিলতি আমাদের নজরে এসেছে। তবে সার্বিক ভাবে বরাহনগরে মাটির তলায় পাইপের অবস্থান জানতে আমরা চিন্তাভাবনা করছি।” এ দিকে কেএমডিএ-র ডিজি (জল সরবরাহ) রজতমোহন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আর্বান রিনিউয়াল মিশন প্রকল্পের আওতায় জল সরবরাহের যে কাজ হয়েছে তার নকশা-সহ প্রকল্পের রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট পুরকর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে। তবে পুরনো পাইপলাইনের নকশা পুরসভা চাইলে তা দেওয়া যাবে।” পুরনো পাইপলাইন নিয়ে ওঠা অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, “বিভিন্ন রকমের পাইপের মেয়াদ বিভিন্ন রকমের। পুরনো দিনের পাইপলাইনের মেয়াদ শেষ হলে অবশ্যই তা বদলানো হয়।”

ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.