সুব্রত ভট্টাচার্য বনাম ট্রেভর জেমস মর্গ্যানের স্কোর লাইন কত? ৪-১।
মর্গ্যান বনাম মোহনবাগানের স্কোর লাইন ৪-২।
চলতি মরসুমে ডার্বির স্কোর মোহনবাগানের পক্ষে ২-০।
উপরের তিনটি পরিসংখ্যানের সঙ্গে যাঁর উনিশ মাসের কোচিং জীবনের যোগ সেই মর্গ্যান এগুলো শুনে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করেন। বললেন, “ইতিহাস নিয়ে আমি কখনও মাথা ঘামাই না। গত বছর চারটে ম্যাচ জিতেছি ওদের বিরুদ্ধে। এ বার ওরা জিতেছে। তাতে কী হল? ও সব নিয়ে আপনারা ভাবুন,” মুখের ভঙ্গিতে তীব্র বিরক্তি। বেরিয়ে আসে রাগও। অনুশীলন করতে নেমেই এক ক্লাব কর্মীকে ডেকে নেন মোহনবাগান টিডি। তার পর নির্দেশ, “মিডিয়ার কোনও লোক যেন মাঠের মধ্যে না ঢোকে। ছবি না তোলে!” নির্দেশ অমান্য করে কেউ ঢুকে পড়লে নিজে গিয়ে তাঁকে গ্যালারিতে তুলেও দিয়ে এলেন কয়েকবার! দীর্ঘ কোচিং জীবনে সুব্রত ভট্টাচার্য মিডিয়াকে কখনও এ ভাবে তাড়া করেছেন? কারও মনে পড়ছে না। কেন আপনি এ রকম করলেন? “আরে আমি যে সেটপিস গুলো করাচ্ছি সেগুলো দেখিয়ে দেবে। এটাই ভয়। ওরাও তৈরি হয়ে যাবে। আমার পরিশ্রমটাই কাজে লাগবে না,” নিজের ঘরের চেয়ারে বসে বলে দেন অতি সতর্ক সুব্রত। আই লিগের মরণ বাঁচন ম্যাচের আগে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের দুই ‘সেনাপ্রধান’ এর অবস্থা অনেকটা দড়ির উপর হাঁটতে থাকা সেই লোকটার মতো, যিনি পা ফস্কালেই পড়ে যাবেন গভীর খাদে। যেখান থেকে বাঁচা প্রায় অসম্ভব। আই লিগ টেবিলের অঙ্কে চোখ বোলালে সেটা মালুমও হবে। পরিস্থিতি যা তাতে ডেম্পোর সঙ্গে খেতাবের লড়াইয়ে টিকে থাকতে হলে জিততেই হবে টোলগে ওজবে বা ওকোলি ওডাফাদের। যে হারবে সেই কার্যত ছিটকে যাবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। ড্র হলে দু’জনেরই লিগ জয়ের আশার গঙ্গাপ্রাপ্তি। |
বৃহস্পতিবার টিমকে চাঙ্গা করতে মনোবিদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গল কোচ। আপনার টিমের মনোবল কি এতটাই তলানিতে যে...? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে যখন মর্গ্যান ক্লান্ত, তখনই হঠাৎ সেখানে হাজির এক স্বঘোষিত জ্যোতিষী! গত বছর হাড়গোড় নিয়ে এসে ক্লাব তাঁবুতে পুজো-আচ্চা করেছিলেন। এ বার তাঁর ভবিষ্যৎবাণী, “সৌমিক যদি খেলে তা হলে ইস্টবেঙ্গল জিতবেই। না জিতলে আমি মাথার চুল কামিয়ে ফেলব।” যা শুনে ভিড় করে থাকা লাল-হলুদ সমর্থকদের ম্লান মুখে কিছুটা আলো। মজার ব্যাপার হল, এ দিন ক্লাবকে টিমের যে তালিকা দিয়েছেন মর্গ্যান তাতে প্রথম একাদশে সৌমিক দে-র নামই নেই। সেটা জানার পর এক সমর্থক মর্গ্যানকে অনুরোধও করে ফেললেন, “স্যর, সৌমিকদাকে নামান, আমরা জিতে যাব। জ্যোতিষী বলছে।” কটমট করে তাঁর দিকে তাকিয়ে তাঁবুতে ঢুকে যান টোলগেদের কোচ।
একই রকম আবেদন এল মোহনবাগান তাঁবুতেও। মাঠ থেকে বেরোনোর সময় একটি ফ্যান ক্লাবের কয়েক জন সদস্য সুব্রতর কাছে আবদার করলেন, “বাবলুদা জিলানিকে নামিয়ে দিন। বড় ম্যাচে পয়া। এখনও হারেনি। ওদের সেই ডগলাসের মতো,” সুব্রত ভ্রু কোঁচকান। হাসেন। মোহন টিডির চিন্তায় অবশ্য শুক্রবার রাত পর্যন্ত ঘুরপাক খাচ্ছে শুরুতে জেলেনি না ব্যারেটো? বিপক্ষের মাঝমাঠকে ভন্ডুল করা না, ওডাফা-সুনীলকে বল সাপ্লাই দেওয়া কোনটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত। “অনেক ভাবতে হচ্ছে। অঙ্ক করতে হচ্ছে। রাতে ভেবে কাল ম্যাচের আগে সিদ্ধান্ত নেব,” বলছিলেন সুব্রত। |
তুকতাক, পয়া-অপয়া, কালীঘাট-তারাপীঠে পুজো, জ্যোতিষবাঙালির দু’ভাগ হয়ে যাওয়া অনাদি-অনন্তকালের ডার্বিতে নতুন নয়। প্রচুর গল্প-গাথা জড়িয়ে আছে এই ম্যাচকে ঘিরে। মোড়ের আড্ডায় বা চায়ের দোকানে পাকা চুলের লোকেরা এক জায়গায় হলে তা বেরিয়ে আসে। এখন অবশ্য সব আলোচনা কম্পিউটার বা ল্যাপটপে। ফেস বুক, টুইটারের সৌজন্যে। সেখানে উপচে পড়ছে নানা মন্তব্য-টীকা টিপ্পনী, মজাদার ছড়া। সঙ্গে কোচেদের কী টিম করা উচিত তা নিয়েও নানা পরামর্শ। ইস্টবেঙ্গলের ফ্যান ক্লাব রিয়েল পাওয়ারের এক সদস্য সৌরভ বসু ফেসবুকে এ দিন লিখেছেন, “ইন্টারভিউ দিয়ে একটা চাকরি পেয়েছিলাম। বন্ধুরা বিশ্বাস করুন, শনিবার ওরা জয়েন করতে বলেছিল। আমি বলেছি সোমবার করব। ওরা রাজি নয়। আমি যাচ্ছি না।” এ রকম আবেগ তা হলে আছে এখনও! এবং আছে বলেই চিন্তিত প্রশাসন। দু’টো ক্লাবকেই পুলিশের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে কোচ-ফুটবলাররা যেন নিজেদের গাড়ি মাঠে না নিয়ে আসেন। সবাই যেন এক সঙ্গে টিম বাসে যুবভারতীতে ঢোকেন। যাতে নিরাপত্তা দেওয়া সহজ হয়। টিকিট এবং রেফারি নিয়ে আকচা-আকচির মাঝে এই সিদ্ধান্তে অবশ্য সম্মতি জানিয়েছে দুই ক্লাবই। নিরাপত্তার জন্য কয়েকশো ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ করছে ম্যাচের উদ্যোক্তা ইস্টবেঙ্গল। খেলা দেখানোর জন্য সাড়ে চারশো স্কুল ছাত্রকে নিয়ে আসছে তাঁরা। যা অভিনব। আবার মিশরে মঙ্গলবারের ফুটবল মাঠের দাঙ্গায় নিহতদের স্মৃতিতে নীরবতা পালনের জন্য ম্যাচ কমিশনারের কাছে আবেদন করেছেন দু’দলের কর্তাই।
কিন্তু পুলিশের ঢাল তো দরকার ম্যাচের পরে। তার আগের নব্বই মিনিট মাঠে কী হবে? রক্ষণের নিরাপত্তা এবং আক্রমণ নিয়ে দুই কোচ যে দু’দিকে হাঁটছেন। মর্গ্যান এ দিন তাঁর টিম দেখাননি। নিজে এবং সহকারী কোচেদের নিয়ে ম্যাচ খেলেছেন। যে দল তিনি গড়েছেন সেখানে বদল হয়েছে আগের ডার্বির ফর্মেশনও। ৪-৫-১ থেকে ৪-৩-১-২ তে ফিরছে ইস্টবেঙ্গল। সামনে টোলগে-রবিন সিংহকে রেখে। মাঝমাঠে ভাসুম-মেহতাব-পেন-পাইতে। রক্ষণে হরমনজিৎ-গুরবিন্দর-ওপারা-রবার্ট। গুরবিন্দরের সামান্য চোট আছে। তিনি না খেললে রাজু গাইকোয়াড় ঢুকবেন টিমে। মর্গ্যান বললেন, “দু’দিন ধরে ফুটবলারদের যা দেখছি, তাতে কাল কিন্তু অন্য ম্যাচ।” ফুটবলারদের কথা বলার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন তিনি। ইস্টবেঙ্গল তাঁবুতে এসেছিলেন এই ম্যাচের বহু উত্থান-পতনের সাক্ষী বিকাশ পাঁজি। টোলগে কিন্তু তাঁকে বলে গেলেন, “কাল আমরাই জিতব। ডার্বিতে আমার এ বছর গোল নেই। কাল গোল করতেই হবে।”
মর্গ্যানের অনুশীলনে মানসিক ভাবে চাঙ্গা করার দাওয়াই ছিল। সুব্রতর অনুশীলনে ছিল লক্ষ্যে পৌছানোর রাস্তা খোঁজার চেষ্টা। রক্ষণ-মাঝমাঠ জমাট করার পাশপাশি সেট পিসে জোর দিলেন মোহন টিডি। হাদসন লিমা গোটা কুড়ি কর্নার করলেন। হেড করতে উঠলেন জেলেনি, আনোয়াররা। ফ্রি কিকও অনুশীলন হল। টোলগে-ওপারার ডামি করা হল অসীম, মুরলীকে। বোঝা যাচ্ছিল, আগের দুটি ডার্বির মতো এ বার নতুন কোনও জাল বিছিয়ে দিতে চাইছেন সুব্রত। মোহনবাগানের টিমে ওডাফা-সুনীলকে রেখে পিছনে হাদসন-রাকেশ-জুয়েলকে রাখা হচ্ছে। সঙ্গে ব্যারেটো অথবা জেলেনি। চোট থাকলেও খেলছেন রহিম নবিও। সুরকুমার, কিংশুক, আনোয়ারের সঙ্গে রক্ষণে। দীর্ঘদিন পর মোহনবাগান অনুশীলনের সময় জিমে কোনও চোট পাওয়া ফুটবলার নেই। তাতে অবশ্য আশ্বস্ত হচ্ছেন না সুব্রত। বলছিলেন, “চোট সারিয়ে ফিরেছে। কিন্তু ফিটনেস কি ফিরেছে?”
মর্গ্যানের লক্ষ্য চাকা উল্টোদিকে ঘোরানো। সুব্রত চান ডার্বি জয়ের হ্যাটট্রিক। যুবভারতী কাকে নিঃস্ব করবে, কাকে জয়ের মালা পরিয়ে ড্রেসিংরুমে ফেরাবে শনিবার সন্ধ্যার আগে সেটা জানা যাবে না। কিন্তু এটা নিশ্চিত ভাবে লিখে দেওয়া যায়, যিনি ব্যর্থ হবেন, পরের বার তাঁকে কোচের চেয়ারে ফিরতে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হবে।
|
শনিবারে আই লিগ
মোহনবাগান: ইস্টবেঙ্গল (যুবভারতী ২-০০) |