টুজি স্পেকট্রাম সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলিয়াছে। সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখিয়া সেই প্রশ্নটি আলোচনা করা প্রয়োজন। প্রশ্ন একেবারে মূলে। কী প্রক্রিয়ায় স্পেকট্রাম-এর লাইসেন্স বণ্টন করা হইবে, তাহা সরকারের বিচার্য। অবশ্যই সেই প্রক্রিয়াটি আইনসম্মত হওয়া দরকার। অবশ্যই সেই প্রক্রিয়ায় কিছু মৌলিক ন্যায়-নীতি মান্য করা দরকার। বিশেষত বণ্টনের প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ, যুক্তিযুক্ত এবং সমদৃষ্টিসম্পন্ন হওয়া জরুরি। এই নীতিগুলি লঙ্ঘিত হইলে তাহার যথাবিহিত বিচার হওয়া আবশ্যক, অপরাধীদের শাস্তি বিধেয়। বস্তুত, ভূতপূর্ব টেলিকম মন্ত্রী এ রাজা-সহ যে কর্তাব্যক্তিরা টুজি স্পেকট্রাম মামলায় দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হইয়াছেন, তাঁহাদের যথাযথ বিচার যত দ্রুত সম্পন্ন হয়, ততই মঙ্গল। কিন্তু তাহার অর্থ এই নয় যে, স্পেকট্রাম-এর লাইসেন্স একমাত্র ‘অকশন’ বা নিলামের ভিত্তিতেই বণ্টন করিতে হইবে, অন্য কোনও ভাবে তাহা বণ্টন করা চলিবে না। নিলাম একটি পদ্ধতি, একমাত্র পদ্ধতি নয়। এবং, কিছু মাপকাঠিতে নিলাম শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি হইলেও সব মাপকাঠিতে নয়। বিশেষত, যে বাজারে মুষ্টিমেয় কয়েকটি প্রতিযোগীর প্রবল দাপট, সেখানে নিলামের প্রক্রিয়াটি ব্যবহার করিয়া তাহারাই আপন দাপট আরও বাড়াইয়া লইতে পারে। তাহা প্রতিযোগিতার অনুকূল নয়, সুতরাং কাম্য নয়। ভারতের টেলিকমিউনিকেশনের বাজারে এই সমস্যাটি প্রবল। নূতন লাইসেন্স বণ্টনের সময়ে বাজারের প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করিবার জন্য নিলামের পরিবর্তে অন্য পদ্ধতি অনুসরণ করা যুক্তিযুক্ত কি না, তাহা লইয়া বিভিন্ন মত থাকিতেই পারে। এই বিষয়ে কী করণীয়, তাহা শাসনবিভাগের নিজস্ব এক্তিয়ারভুক্ত। শাসনবিভাগের সিদ্ধান্ত আইনসম্মত না হইলে বা সেই সিদ্ধান্ত রূপায়ণের প্রক্রিয়ায় আইন লঙ্ঘিত হইলে তাহার বিচার নিশ্চয়ই আদালতের এক্তিয়ারে, কিন্তু তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। এ দেশে বিচারবিভাগের অতিসক্রিয়তার অভিযোগ বহুচর্চিত। লক্ষণীয়, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্বয়ং এই বিষয়ে চেতাবনি উচ্চারণ করিয়াছেন, বিচারবিভাগকে লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম না করিবার উপদেশ দিয়াছেন। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় সেই প্রশ্নটিকে আবার প্রাসঙ্গিক করিয়া তুলিল না কি?
এই রায়ে শতাধিক সংস্থার লাইসেন্স যে ভাবে বাতিল করিয়া দেওয়া হইয়াছে, তাহাও বিস্ময়কর। লাইসেন্স বণ্টনের প্রক্রিয়ায় যদি পদ্ধতিগত ত্রুটি ঘটিয়া থাকে, যদি সফল সংস্থাগুলি অতি সস্তায় লাইসেন্স অর্জন করিয়া থাকে, তাহার প্রতিকারে আদালত তাহাদের উপর বাড়তি ফি ধার্য করিতে পারিত, প্রয়োজনে জরিমানাও লইতে পারিত। অনেক ক্ষেত্রেই পদ্ধতিগত ত্রুটি সংশোধনের জন্য এমন ব্যবস্থা লওয়া হইয়া থাকে। কিন্তু তাহার পরিবর্তে সকলের সব লাইসেন্স বাতিল করিয়া দিলে গোটা বাজারেই অপ্রয়োজনীয় অব্যবস্থা ঘটিতে পারে। বিবিধ অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। বস্তুত, দিয়াছে। ইতিমধ্যেই লাইসেন্সপ্রাপ্ত সংস্থাগুলি যে বিনিয়োগ করিয়াছে, তাহার ভবিষ্যৎ কী হইবে? সরকার লাইসেন্স ফি বাবদ যে অর্থ পাইয়াছিল তাহার কী হইবে? দীর্ঘমেয়াদি পরিণামও উদ্বেগজনক, কারণ এমন ভাবে পাইকারি লাইসেন্স বাতিলের ফলে বিনিয়োগকারীদের নিকট, বিশেষত বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিকট ভারতের টেলিকমিউনিকেশন বাজার সম্পর্কে ভুল সংকেত যাইবে, এমন আশঙ্কা প্রবল। অথচ সাধারণ বুদ্ধিতে এই পরিস্থিতির কোনও প্রয়োজন ছিল বলিয়া মনে হয় না। সংশয় হয়, আদালত আইনি বিচার পরিচালনার নির্দিষ্ট ও সীমিত ভূমিকাটিতে নিজেকে সংহত ও সংযত না রাখিয়া বৃহত্তর ‘জনস্বার্থ’ রক্ষায় অতি-উদ্যোগী হইবার ফলেই এমন সীমা-অতিক্রমী বিচার ঘটিল না তো? সুপ্রিম কোর্ট এ দেশের শাসনতন্ত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। বিচারের ক্ষেত্রে তাহার কথাই শেষ কথা। এই কারণেই মহামান্য আদালতের নিকট আবেদন, তাঁহারা গভীর ভাবে সমগ্র বিষয়টি বিবেচনা করিয়া দেখুন। এই রায়ের পরে তাহার প্রয়োজন সমধিক। |