|
|
|
|
নতুন মতাদর্শগত দলিল |
শিল্প ভাবনায় চিনের পথ বাতিল করছে সিপিএম |
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
বুদ্ধদেব ভট্টাচাযের্র শিল্পনীতিতে ‘সিলমোহর’ বসিয়েছিল সিপিএম। মতাদর্শগত দলিলের ধাক্কায় সেই ‘সিলমোহর’ এ বার কার্যত ধুয়ে-মুছে যেতে চলেছে।
২০০৫ সালের দিল্লি পার্টি কংগ্রেসে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানিয়ে ‘নির্দিষ্ট কিছু নীতিগত বিষয়ে’-র উপর একটি দলিল গৃহীত হয়। ওই দলিলেই প্রথম সিপিএম মেনে নেয় যে, কোনও রাজ্য সরকারের পক্ষেই শুধু মাত্র নিজের রাজ্যের জন্য বিকল্প নীতি গ্রহণ করা সম্ভব নয়। কাজেই কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি মেনে রাজ্যেও বেসরকারি লগ্নি নিয়ে এসে শিল্পায়নের রাস্তায় হাঁটতে হবে। ‘বেঙ্গল লাইন’ এর সমর্থকেরা দাবি করেছিলেন, এই দলিল আসলে শিল্পায়ন প্রশ্নে তাঁদের লাইনের জয়। এর পরেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার রাজ্যে বৃহৎ বেসরকারি লগ্নি টানতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তৈরি হয় নতুন স্লোগান, ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। সিঙ্গুরে টাটার ছোট গাড়ির কারখানা গড়তে উদ্যোগী হন বুদ্ধদেব-নিরুপম। নন্দীগ্রাম ও রাজ্যের অন্যত্র সালিমদের বিদেশি সংস্থার লগ্নি টানারও চেষ্টা হয়।
কিন্তু আসন্ন পার্টি কংগ্রেসে যে মতাদর্শগত দলিল পেশ হতে চলেছে, শিল্পনীতির প্রশ্নে তা ২০০৫-এর দলিলকে কার্যত ‘অপ্রাসঙ্গিক’ করে দিচ্ছে।
মতাদর্শগত দলিলের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পনীতির সম্পর্ক কোথায়? সিপিএমের এক পলিটব্যুরো সদস্যের বক্তব্য, এ বারের মতাদর্শগত দলিলের মূল বিষয় চিনের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। কিন্তু চিনের আড়ালে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়নের প্রশ্নকেই মূল গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ওই সিপিএম নেতার কথায়, “বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার চিনের দেং জিয়াও পিঙের আদলে শিল্পায়নের পথে এগোতে চেয়েছিলেন। বড় পুঁজিপতিদের আহ্বান জানিয়ে সরকারের তরফে বাড়তি সুযোগসুবিধা দেওয়া হয়েছিল। তাতেই দল মূল জনভিত্তি হারায়। বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ক্ষমত্যচ্যুত হওয়ার আগেই তাই বিজয়ওয়াড়ায় কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত অধিবেশেন ঠিক হয়েছিল, মতাদর্শগত দলিলকে সময়োপযোগী করা প্রয়োজন।”
চিনের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সিপিএমের মধ্যে পক্ষে-বিপক্ষে দু’টি মতই উঠে এসেছে। সিটুর নেতৃত্বের মতো কট্টরপন্থীদের বক্তব্য, পুঁজিপতিদের সঙ্গে এই ভাবে জোট বাঁধতে গিয়ে চিনের কমিউনিস্ট পার্টিতেও অনেক পুঁজিপতি ঢুকে পড়েছেন। বুদ্ধদেব-নিরুপমের সঙ্গে টাটা-সালিমদের দহরম-মহরম দেখে এ রাজ্যের মানুষ মনে করেছিল, ‘গরিবের পার্টি’ এখন ‘বড়লোকদের পার্টি’ হয়ে গিয়েছে। যদিও সীতারাম ইয়েচুরি-বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা এখনও মনে করছেন, চিনের মূল নীতিতে কোনও ভুল নেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তা প্রয়োগ করতে গিয়েই সমস্যা হয়েছিল। যার পাল্টা যুক্তি দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে, সেই সমস্যাটা সব সময়ই হবে। কারণ চিনে একদলীয় শাসনে যা করা সম্ভব, ভারতের বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তা করা সম্ভব নয়।
চিনের সরকার যে ভাবে গায়ের জোরে জমি অধিগ্রহণ করতে পারে, শ্রমিকদের যে কোনও শর্তে কারখানায় কাজ করাতে বাধ্য করতে পারে, এ দেশে তা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে দুই শিবিরের সমঝোতায় তাই মধ্যপন্থা
হিসেবে ঠিক হয়েছে, চিনের সমাজতন্ত্র যে পুরোপুরি ভুল, তা আগ বাড়িয়ে বলার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ওই ব্যবস্থায় যে সব ভুলত্রুটি রয়েছে, সেগুলি সম্পর্কে দলের সদস্যদের সতর্ক করা হোক।
যার অর্থ স্পষ্ট। সিপিএম নেতাদের ব্যাখ্যা, পশ্চিমবঙ্গের শিল্পায়নের নীতিতে কোথায় কোথায় ভুল ছিল, তা তাত্ত্বিক ভাবে দলের মধ্যে ব্যাখ্যা করা হবে। কিন্তু সিপিএম নেতৃত্বই যে এই ভুল করেছিলেন, সে সম্পর্কে কিছু বলা হবে না। ২০০৫-এর ওই দলিলে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পনীতি ছাড়াও আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নিতে এবং পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়নের কাজে বিশ্বব্যাঙ্ক, এডিবি, ডিএফআইডি বা জাপান ব্যাঙ্কের ঋ
ণ গ্রহণে সায় দিয়েছিল সিপিএম। দিল্লির ওই পার্টি কংগ্রেসেই দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রকাশ কারাট। পশ্চিবঙ্গের শিল্পায়নের নীতি সংক্রান্ত দলিলে তিনিই সিলমোহর বসান। কাজেই তাঁর পক্ষেও দায় এড়ানো কঠিন। সে কারণেই ঘুরপথে দলিলটিকে ‘অপ্রাসঙ্গিক’ করে দেওয়ার কৌশল নেওয়া হচ্ছে।
এবং এই ‘অপ্রাসঙ্গিক’ করার কাজটা করা হচ্ছে যথেষ্ট সূক্ষ ভাবে। ১৯৬৮ সালে বর্ধমান প্লেনামে গৃহীত আদর্শগত প্রস্তাব, পরবর্তী কালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণ বিশ্লেষণ করে ১৯৯২ সালে মাদ্রাজে ‘কয়েকটি মতাদর্শগত বিষয় প্রসঙ্গে’ শীর্ষক যে দলিল গৃহীত হয়েছিল, নতুন দলিলে সে সবের উল্লেখ থাকছে। কিন্তু চিনকে অনুসরণ করে যে দলিল তৈরি হয়েছিল, চিনের প্রেক্ষিতে তৈরি মতাদর্শগত দলিলে তাকে ব্রাত্য রাখা হচ্ছে! তার জায়গা হতে চলেছে হিমঘরে। |
|
|
|
|
|