অনির্বাণ রায় • জলপাইগুড়ি |
নেহাতই আটপৌড়ে ছাপা শাড়িতে সোমবার মঞ্চে মানপত্র নিতে উঠেছিলেন পঞ্চাশ পেরোনো ডলি সরকার। মঞ্চের চড়া আলো আর সামনে বসে থাকা অজস্র কালো মাথার ভিড় দেখে ঘোর লেগেছিল তাঁর। বুধবার বাড়ির দাওয়ায় বসে তিনি বলেন, “একটা ভাল শাড়ি পড়ে যে মঞ্চে যাব তারও উপায় নেই। জীবনে যা কিছু ছিল তা দিয়ে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছি। বিয়ে দিয়েছি। নিজের দিকে তাকানোর ফুরসতই ছিল না। সাধারণ পোশাকে কেমন করে ঝলমলে মঞ্চে উঠলাম জানি না। ওঁরা কিছু মনে করলেন কিনা!” ‘ওঁরা’ মানে যাঁরা ডলি দেবীকে মানপত্র, শাল দিয়ে সম্মান জানালেন। কেন ওই সম্মান? সুদৃশ্য মানপত্রে লেখা, ‘আপনার নিরলস কর্মক্ষমতায় অটুট পারিবারিক, সামাজিক বন্ধন।’ ১৯৮৮ সালে হঠাৎ ডলি দেবীর স্বামী পেশায় কাঠ মিস্ত্রি নিলয় সরকারের মৃত্যু হয়। দুই মেয়ে এক ছেলে তখন ছোট্ট। এর পরে যা কিছু জমানো টাকা, সরকারের থেকে পাওয়া বিধবা ভাতা থেকে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করানো, দুই মেয়ের বিয়ে দেওয়া সবই একা হাতে সামলেছেন। সে কারণেই সম্মান। শুধু ডলি দেবী নয়। জলপাইগুড়ি শহরের ২২ নম্বর ওয়াডর্র্ উৎসব, যার নাম ‘এসো আলোর বৃত্ত গড়ি’ সেই উৎসবে এ বার সম্মান জানানো হয়েছে ১৫ মহিলাকে। ছেলেমেয়ের শৈশব অবস্থায় যাদের স্বামী প্রয়াত হন। কারও নিরুদ্দেশ। নিজে কাজ করে বহু কষ্টে তাঁরা ছেলেমেয়েদের পড়িয়েছেন। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। এমন মহিলাদের বাছাই করে ওয়ার্ড উৎসবের মঞ্চ থেকে সম্মানিত করা হয়। সোমবার তিনদিনের উৎসবের শেষ দিনে সকলকে মঞ্চে ডেকে হাতে তুলে দেওয়া হয় মানপত্র, শাল। মাসকলাই বাড়ির পবিত্র পাড়ার সুখিয়া দেবীর স্বামী বিশ্বেশ্বর পাসোয়ান প্রায় ২০ বছর আগে মারা গিয়েছেন। পেশায় ভ্যান চালক স্বামীর মৃত্যুর পরে সংসার চালাতে পরিচারিকার কাজ শুরু করেন সুখিয়া দেবী। সেই উপার্জনে ২ মেয়ে তিন ছেলেকে শিক্ষিত করেছেন, মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। সম্মান পেয়েছেন কুন্তি দাসও। তিনি পেশায় রাজমিস্ত্রি স্বামী প্রয়াত হওয়ার পরে ২ মেয়ে ২ ছেলেকে পড়াশোনা করিয়েছেন। বছর ২৫ আগে স্বামী নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পরে বাধ্য হয়ে নিজে উপাজর্নের পথ খুঁজে নেন মাসকলাইবাড়ির মমতা কর। তিনি ৫ ছেলেমেয়েকে পড়িয়েছেন। এক মেয়ে এখন এলাকার একটি শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষিকা। মমতা দেবী, যশোদা অগ্রবালের মতো ১৫ জন মহিলার লড়াইয়ের কাহিনি রয়েছে। ওয়ার্ড উৎসবে এমন ব্যতিক্রমী সম্মানের উদ্যোগ যার মস্তিস্কপ্রসূত তিনি এলাকার কাউন্সিলার তথা জলপাইগুড়ি পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান পিনাকী সেনগুপ্ত। গত বছরের উৎসবে এলাকার প্রবীণ নাগরিকদের সম্মান জানানোর পরে এ বার ১৫ জন সংসার সামলানো মহিলাকে সংবর্ধনা জানাতে উদ্যোগী হন তিনি। পিনাকী বাবু বলেন, “আশেপাশে এমন উদাহরণ ছড়িয়ে রযেছে। আমরা দেখেছি, জেনেছি. কিন্তু ওই মায়েদের দুঃখ, কষ্ট, ত্যাগ উপলব্ধি করার ক্ষমতা আমাদের নেই। তাঁদের জীবন সংগ্রামকে মর্যাদা দিতে এই উদ্যোগ।” বাসাবাড়িতে কাজ করে সংসার সামলানো কুন্সি দেবীর কথায়, “প্রথমে যখন শুনলাম ভাবতে পারিনি সমাজে আমাদেরও কিছু অবদান রয়েছে। মঞ্চে ডেকে সম্মান জানানো হল। সামনে বসে থাকা কত লোক হাততালি দিল। স্বামীর ছবিটা বার বার চোখে ভাসছিল।” বুধবার দুপুরে চোখের জল মুছলেন তিনি, হাতে ধরা রয়েছে মানপত্র, যাতে লেখা, ‘রূপহীন, জ্ঞানাতীত ভীষণ শকতি, ধরেছে আমার কাছে জননী মুরতি।’ |