ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার ফিরিয়ে নেওয়ার ভাবনাকে স্বাগত জানাল শিল্পমহল। ভিডিওকন-কর্তা বেণুগোপাল ধুত থেকে শুরু করে বণিকসভা সিআইআই-এর পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা সৌগত মুখোপাধ্যায় সকলেরই মতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করলে তা হবে কর্মসংস্কৃতির লক্ষ্যে বড় পদক্ষেপ। যা রাজ্যে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করবে। তবে একই সঙ্গে শিল্পপতিদের বক্তব্য, বিনিয়োগ টানতে এটুকু পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়। জমি অধিগ্রহণ এবং জমির ঊর্ধ্বসীমা আইনের মতো সমস্যাগুলিরও দ্রুত নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন।
বাম নেতারা অবশ্য স্বাভাবিক ভাবেই রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর মঙ্গলবারের ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। রাজ্য সরকারকে এই পদক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকতে বলে তাঁদের মন্তব্য, কর্মসংস্কৃতি আর কর্মচারীদের স্বার্থরক্ষার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই।
যদিও পূর্ণেন্দুবাবু নিজের অবস্থানে অনড় থেকে বুধবার মহাকরণে জানিয়েছেন, রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার তুলে দেওয়ার জন্য সার্ভিস রুলে প্রয়োজনীয় সংশোধনী নিয়ে আসার প্রস্তাব ‘যথাসময়ে’ মন্ত্রিসভার বৈঠকে পেশ করা হবে। তিনি বলেন, “বাম আমলে কর্মচারীদের ‘সার্ভিস রুল’-এর ভল্যুম-টু-তে চার নম্বর ধারার দু’নম্বর অনুচ্ছেদে পুরোমাত্রায় ট্রেড ইউনিয়ন করার যে অধিকার দেওয়া হয়েছে, তা বেআইনি। যাঁরা আমার বক্তব্যের বিরোধিতা করছেন, তাঁরা অর্ধেক জেনে বা না-জেনে মন্তব্য করছেন।”
রাজ্য সরকারের ঘোষণা ঘিরে রাজনৈতিক মহলে যেমন চাপানউতোর শুরু হয়েছে, তেমনই আলোড়ন তৈরি হয়েছে শিল্পমহলেও। বিরূপ ভাবমূর্তির অসুখে ভোগা রাজ্যের ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্ত ভাল দাওয়াই হতে পারে বলেই বিনিয়োগকারীদের মত। বেণুগোপাল ধুত এ দিন দিল্লিতে বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সাহসী। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও রাজ্যে বন্ধ-ধর্মঘট নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দলের চাপে করে উঠতে পারেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুবিধা হল, তৃণমূল কংগ্রেসে তাঁর কথাই শেষ কথা।” অন্য দিকে কলকাতায় সৌগত মুখোপাধ্যায় বলেন, “সরকারি বা বেসরকারি কোনও ক্ষেত্রেই ধর্মঘট কাম্য নয়। ধর্মঘট আর্থিক বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের পথে বাধা তৈরি করে। শিল্পমহল রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছে।” মার্চেন্ট চেম্বার অফ কমার্সের প্রেসিডেন্ট দীপক জালানেরও মতে, বেসরকারি ক্ষেত্রে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের উপরেও এমন সিদ্ধান্ত প্রযোজ্য হওয়া উচিত। তাঁর কথায়, “রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্ত শিল্পমহলের কাছে ইতিবাচক বার্তা দেবে। লগ্নিকারীরা বুঝবেন এই সরকার শিল্প গড়তে আগ্রহী।”
ষাটের দশকে বামপন্থীদের হাত ধরে এ রাজ্যের শিল্পক্ষেত্রে যে ঘেরাও-বন্ধ-ধর্মঘটের সূত্রপাত, তা পশ্চিমবঙ্গকে লগ্নির গন্তব্যের তালিকায় অনেক পিছনে ঠেলে দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট মহলের মত। সেই জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন যে খানিকটা হলেও ‘ভুল’ ছিল, পরে তা স্বীকার করেছিলেন জ্যোতি বসুও। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে বন্ধ-ধর্মঘট নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। বন্ধ-বিরোধী বুদ্ধবাবু প্রকাশ্যে এ-ও বলেছিলেন, “দুর্ভাগ্যজনক ভাবে আমি এমন একটি দল করি, যারা বন্ধ ডাকে।” কিন্তু এই প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত দলের চাপের কাছেই মাথা নোয়াতে হয়েছিল তাঁকে।
তবু শাসন ক্ষমতায় থাকাকালীন বন্ধ-ধর্মঘট নিয়ে সিপিএমের মধ্যে মতাদর্শগত টানাপোড়েন ছিল। কিন্তু এখন বিরোধী আসনে চলে আসা দলের পক্ষে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা অনেক বেশি সহজ ও স্বাভাবিক বলেই মনে করছেন রাজনীতির কারবারীরা। তাঁদের মতে, মমতা বামপন্থীদের থেকেও বেশি বামপন্থী হয়ে ‘চলছে না, চলবে না’-র রাজনীতি করে ক্ষমতায় এসেছেন। এখন তাঁর লড়াই ‘বিক্ষোভকারী’ থেকে ‘প্রশাসক’ হয়ে ওঠা। অন্য দিকে সিপিএম মমতার পথেই হেঁটে তাঁকে মোকাবিলা করার কথা ভাবছে। সেই কারণেই, সরকারি কর্মচারীদের ‘আন্দোলন করে অর্জিত অধিকার’ কেড়ে নেওয়ার ‘অপচেষ্টার’ বিরুদ্ধে তারা সরব।
সিটু নেতা তথা সিপিএমের রাজ্যসভার সদস্য তপন সেন এ দিন দিল্লিতে বলেন, “এই সিদ্ধান্ত বামপন্থীদের উপর আঘাত হানার চেষ্টা। সরকারি কর্মচারীরা ট্রেড ইউনিয়ন করেন না। সিপিএম আর সিটু এক নয়। কর্মচারীদের অধিকারকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন স্বীকৃতি দিয়েছে। ভারত ওই সংগঠনের সদস্য। সেই অধিকার একটা রাজ্যের সরকার কাড়ে কী করে!” এআইটিইউসি-র সাধারণ সম্পাদক এবং সিপিআই সাংসদ গুরুদাস দাশগুপ্তেরও বক্তব্য, “শ্রমিকদের যে সমস্ত অধিকার সংবিধান স্বীকৃত, কোনও একটা রাজ্য তাতে বাধা দিতে পারে না। ভারতের কোথাও এই ঘটনা ঘটেনি। আমরা পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বলছি, এই পথে হাঁটা যাবে না।” আর সিপিএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিমের মন্তব্য, “শ্রমিক শ্রেণির টুঁটি টিপে ধরা শাসক শ্রেণির ধাত। কিন্তু কোথাও এই চেষ্টা সফল হয়নি। মমতা অনেক কিছুই ঘোষণা করেন, শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয় না।”
তৃণমূলের শরিক দল কংগ্রেসের প্রভাবিত সরকারি কর্মচারীদের সংগঠন কনফেডারেশন অফ স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার কাড়ার চেষ্টার বিরোধিতা করলেও আইএনটিইউসি এখনও স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা আইএনটিউসি-র রাজ্য সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য এ দিন পূর্ণেন্দুবাবুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। পরে তিনি বলেন, “আমি পূর্ণেন্দুবাবুকে বলেছি, এই সব সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া সমীচীন। একক ভাবে কোনও সিদ্ধান্ত সরকারের নেওয়া উচিত নয়।’’ তবে রাজ্য সরকারের অবস্থানকে সমর্থন জানিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের একাংশ বলছেন, সরকারি কর্মীরা সংগঠন করতে পারলেও শ্রমিকদের মতো তাঁদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার আইন-স্বীকৃত নয়।
যে বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে পূর্ণেন্দুবাবু এ দিন মহাকরণে বলেছেন, “বাম আমলে সরকারি কর্মচারীদের পুরোপুরি ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার দেওয়ার কথা বলা হলেও তা কিন্তু আসলে দেওয়া হয়নি। ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার দিলেও সরকারি কর্মচারীদের বিনা অনুমতিতে মিছিল-মিটিং, ধর্মঘট করার বা সংবাদপত্রে বিবৃতি দেওয়ার কোনও অধিকার দেওয়া হয়নি। এখন সংগঠনগুলি যা করে, তা বেআইনি।”
এর বিরুদ্ধে সরকার কোনও ব্যবস্থা নেবে কি না জানতে চাওয়া হলে মন্ত্রী বলেন, “সরকার চাইলে এ সব বন্ধ করে দিতেই পারে। কিন্তু আমরা গণতান্ত্রিক। তাই কোনও ব্যবস্থা নেব না।” যদিও এ দিনই মহাকরণে কর্মী সংগঠনগুলিকে পুলিশের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, মুখ্যসচিবের নির্দেশানুসারে এ বার থেকে তারা যেন প্রেস কর্নারের বদলে নিজেদের অফিসেই সাংবাদিক বৈঠক করে। যদিও সংগঠনগুলির তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা ফের প্রেস কর্নারেই সাংবাদিক বৈঠক করবে।
গুরুদাসবাবুর অভিযোগ, আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি যখন সাধারণ ধর্মঘট ডেকেছে, তার আগে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে’ পশ্চিমবঙ্গে ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। ওই ধর্মঘট সম্পর্কে পূর্ণেন্দুবাবু এ দিন জানিয়েছেন, তাতে সামিল হতে গেলে রাজ্য সরকারি কর্মী সংগঠনগুলিকে অনেক আগে অর্থ দফতরকে তা জানাতে হবে। এর পরে নিয়ম মেনে সরকার কমিটি তৈরি করবে। সেই কমিটি কর্মী সংগঠনগুলির সঙ্গে বৈঠক করার পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেছেন, “আমরা যে নিয়মে অভ্যস্ত, সেই নিয়মেই চলব। ২৮ তারিখের ১৫ দিন আগে সরকারকে আমরা জানিয়ে দেব, ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকা সাধারণ ধর্মঘটকে আমরা সমর্থন করছি।’’
রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে এই সংঘাতের পরিস্থিতিতে আমজনতা সরকারের পাশেই দাঁড়াবে বলে মনে করছেন ইলেকট্রনিক সফটঅয়্যার প্রমোশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এস রাধাকৃষ্ণন। তাঁর কথায়, “ধর্মঘট মানেই পরিষেবা ব্যাহত হওয়া। ফলে সাধারণ মানুষ ধর্মঘটের বিপক্ষেই।” তবে সরকারের সিদ্ধান্ত সাধারণ ভাবে লগ্নিকারীদের ইতিবাচক বার্তা পাঠালেও বাস্তবে বিনিয়োগ টানতে গেলে রাজ্যকে আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে বলেই শিল্পমহলের মত। তাদের বক্তব্য, সরকারি কর্মচারীদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার বাতিল কর্মসংস্কৃতি ফেরানোর লক্ষ্যে বড়সড় পদক্ষেপ ঠিকই, কিন্তু লগ্নিকারীদের আরও অনেক উদ্বেগ রয়েছে। যার মূলে রয়েছে জমি সংক্রান্ত সমস্যা। যে উদ্বেগের কথা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে সরাসরি জানিয়েও দিয়েছেন শিল্পপতিরা। সেই সব সমস্যার দ্রুত সমাধান না হলে পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে শিল্পের খরা কাটিয়ে ওঠা কঠিন। |